বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিদেশ থেকে শ্রমিক ফিরে আসছে। কিন্তু এর পরেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছেই। গত মে মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২১৭ কোটি ডলার। এ নিয়ে ১১ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ২৮৪ কোটি ডলার। গত মাসের ধারা চলতি মাসে অব্যাহত থাকলে বছর শেষে রেমিট্যান্স প্রবাহের পরিমাণ হবে আড়াই হাজার কোটি ডলার, যা হবে দেশের জন্য নতুন মাইলফলক। মে মাসে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ, আর এগারো মাসের হিসাবে তা সাড়ে ৩৯ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে রেমিট্যান্স এলেই তার বিপরীতে সুবিধাভোগীদের ২ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এতে বছর শেষে সুবিধাভোগীদের নগদ সহায়তা পরিশোধ করতে হবে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। আরো ১ হাজার কোটি টাকার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ দিকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো বিদেশ থেকে যে পরিমাণ ডলার আহরণ করছে তা কাজে লাগাতে পারছে না। ডলারের মূল্য ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ১১ মাসে বাজার থেকে ডলার কিনেছে ৬৫ হাজার কোটি টাকার।
বিদেশ ফেরত কর্মীর পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে ১ এপ্রিল থেকে গত ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিক ফিরে এসেছে ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৪৪১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩ লাখ ৩০ হাজার ৩৯৬ জন। আর নারী ৪৬ হাজার ৪৫ জন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকেই ফিরে এসেছে বেশির ভাগ কর্মী। সাধারণত শ্রমিক ফিরে এলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু রেমিট্যান্স প্রবাহের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রতি মাসেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাচ্ছে।
নগদ সহায়তার জাদু : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নগদ সহায়তার জাদুতে রেমিট্যান্স প্রবাহের এ রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড হচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ২ শতাংশ নগদ সহায়তা ঘোষণা করে সরকার। বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী ৫ হাজার ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নগদ সহায়তা পেতে কেন কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করতে হয় না। রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে এলেই সুবিধাভোগীদের ২ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হয়। আর ৫ হাজার ডলার বা ৫ লাখ টাকার ওপরে কেউ রেমিট্যান্স পাঠালে নগদ সহায়তা পেতে হলে প্রবাসীদের সামগ্রী তথ্য যাচাই বাছাই করা হয়ে থাকে। নগদ সহায়তা ঘোষণা করার পরপরই রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যেতে থাকে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো শ্রমিক কর্মচারীদের পাশাপাশি যারা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করেছিল তাদের কেউ কেউ নগদ সহায়তার জন্য দেশে রেমিট্যান্স আকারে অর্থ পাঠাতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করলেই প্রকৃত চিত্র বের হয়ে যাবে বলে তারা মনে করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ এই দুই অর্থবছরে এক টানা রেমিট্যান্স প্রবাহের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়। যেমন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয় ঋণাত্মক আড়াই শতাংশ। এর পরের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি আরো কমে হয় ঋণাত্মক সাড়ে ১৪ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে এক টানা রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে থাকে। যেমন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয় ১৭ শতাংশ, এর পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয় ১০ শতাংশ। সর্বশেষ গেলো অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয় সাড়ে ১২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরেও রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসেই প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৩৯ শতাংশ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বছর শেষে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে হবে আড়াই হাজার কোটি ডলার।
নগদ সহায়তায় প্রয়োজন হবে ৪২৪০ কোটি টাকা : বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, রেমিট্যান্সের সুবিধাভাগীদের জন্য নগদ সহায়তা বাবদ গত অর্থবছরেও ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের জন্য ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের জন্যও একই অর্থাৎ ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় এর বিপরীতে বরাদ্দকৃত নগদ সহায়তার পুরোটাই ইতোমধ্যে ছাড় করা হয়েছে। নয় মাসেই ইতোমধ্যে পুরো বরাদ্দ শেষ হয়ে গেছে। বাকি তিন মাসের জন্য এ খাতে আরো ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার জন্য সরকারের কাছে ইতোমধ্যে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে আড়াই হাজার কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলে ২ শতাংশ হারে নগদ সহায়তার প্রয়োজন হবে ৫০ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা হিসেবে) ৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা।
৬৫ হাজার কোটি টাকার ডলার কেনা হয়েছে : এ দিকে করোনারভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত বছরের মার্চ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্য আমদানি কমে গেছে। এতে কমে গেছে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারও। এ কারণে রেমিট্যান্স, রফতানি আয়, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানসহ যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে তার বেশির ভাগই উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে। প্রায় সব ব্যাংকের হাতে এখন উদ্বৃত্ত ডলার থাকায় বাজারে চাহিদাও কমে গেছে। বাজারে ডলার বিক্রি করতে না পারায় ব্যাংকগুলো প্রতিদিনই এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আসছে। ডলারের মূল্য পতন ঠেকাতে চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) বাজার থেকে ৭ হাজার ৬৫৬ কোটি ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার স্থানীয় বাজার মূল্য প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এ দিকে বাজার থেকে ডলার কিনে নেয়ায় বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাড়ায় মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যাচ্ছে। তবে করোনার কারণে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা।
তারা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার না কিনলে প্রতি ডলারের দাম ৭০ টাকায় নেমে যেত। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন প্রবাসীরা ও রফতানিকারকরা। মূলত রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখার জন্য এবং রফতানিকারকদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে নিচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মজুদ যেমন শক্তিশালী হয়েছে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রাবাজারও স্থিতিশীল রয়েছে।