সরকার সমালোচক এক সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের জন্য বিমানে বোমা থাকার কথা বলে বেলারুশ কর্তৃপক্ষ নিজ দেশ গ্রিস থেকে লিথুয়ানিয়াগামী একটি ফ্লাইট ঘুরিয়ে নিয়েছে। রায়ানএয়ারের বিমান ঘুরিয়ে নেওয়ার ঘটনাটিকে ‘ছিনতাই’ বলে উল্লেখ করেছেন সংস্থাটির এক নির্বাহী কর্মকর্তা। অপরদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ঘটনাটিকে ‘ন্যাক্কারজনক’ বলে মন্তব্য করেছে।
বিমান ঘুরিয়ে নেওয়ার ঘটনার পর সাংবাদিক এবং আন্দোলনকর্মী রোমান প্রোতেশেভিচকে গ্রেপ্তার করেছে বেলারুশ। দেশটির সম্প্রচারমাধ্যম নেক্সটা মিডিয়া নেটওয়ার্ক তাদের সাবেক সম্পাদকের গ্রেপ্তারের তথ্য নিশ্চিত করেছে। তারা এও জানিয়েছে, ওই বিমানে কোনো বিস্ফোরক পাওয়া যায়নি। কিন্তু বোমার কথা বলেই লিথুয়ানিয়াগামী বিমানটি রাজধানী মিনস্কে ঘুরিয়ে নেওয়া হয়।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে লিথুয়ানিয়াগামী বিমানটিকে মিনস্কের বিমানবন্দরে নিয়ে এসে অবতরণ করানো হয়। এদিকে, মিথ্যা বলে বিমান ঘুরিয়ে ফেলা ও সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলো। বেলারুশের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের’ অভিযোগ তুলেছে দেশগুলো থেকে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তাগণ। তারা বেলারুশের বিরুদ্ধে শাস্তি দাবি করেছেন। ইইউ ও ন্যাটোর হস্তক্ষেপও চেয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব হুঁশিয়ার করে বলেছেন, এ ধরণের অপ্রত্যাশিত আচরণের কারণে ‘গুরুতর পরিণতি’ আসতে পারে।
বেলারুশের বিরোধী নেতা স্ভেতলানা টিকানোভস্কিয়াও সাংবাদিক প্রোতাসেভিচের মুক্তি দাবি করেছেন। গত বছর বেলারুশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর কাছে পরাজিত হন স্ভেতলানা টিকানোভস্কিয়া। ওই নির্বাচনে ব্যাপকভাবে জালিয়াতি হয় বলে অভিযোগ করে আসছেন তিনি।
বিবিসির খবরে আরও বলা হয়, ২৬ বছর বয়সী সাংবাদিক রোমান প্রোতেশেভিচ এথেন্স থেকে আসা রায়ানএয়ারের বিমানটিতে উঠেছিলেন। বিমানটি ভিলনিয়াসের বিমানবন্দরে অবতরণের কিছুক্ষণ আগে বেলারুশের কর্তৃপক্ষ সেটির উড্ডয়নে হস্তক্ষেপ করে। বিমানটিকে নিয়ে যেতে মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান পাঠানো হয় এবং সেটি রায়ানএয়ারের বিমানটিকে মিনস্কের বিমানবন্দরে নিয়ে এসে অবতরণ করায়।
বেলারুশের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বলছে, বোমা হামলার হুমকি ইস্যুতে ব্যবস্থা নিতে প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দেন, কিন্তু হুমকিটি পরে ভুয়া প্রমাণিত হয়।
শেষমেশ নির্ধারিত সময়ের প্রায় সাত ঘণ্টা পর স্থানীয় সময় রাত সাড়ে নয়টার দিকে বিমানটি লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে অবতরণ করে। সেখানে পৌঁছানো যাত্রীরা জানান, মাঝপথে মিনস্কে বিমান অবতরণ সম্পর্কে তাদেরকে আগে থেকে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। এক যাত্রী বলেন, রোমান প্রোতেশেভিচ প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম এবং এটা খুবই দুঃখজনক ছিল।’
বার্তা সংস্থা এএফপিকে মনিকা সিমকিনি নামে আরেক যাত্রী জানান, রোমান প্রোতেশেভিচ শুধু যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন যে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
যেভাবে ঘোরানো হয় বিমানটি
বিবিসির প্রদিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্লাইট এফআর ৪৯৭৮ এথেন্স থেকে ভিলনিয়াসে যাচ্ছিল। তবে লিথুয়ানিয়ার সীমান্তের কাছে পৌঁছানোর পরপরই এটি পূর্ব দিকে ঘুরে মিনস্কের দিকে যাত্রা করে। গ্রিস এবং লিথুয়ানিয়া জানায়, সে সময় বিমানটিতে ১৭১ জন যাত্রী ছিল।
এক বিবৃতিতে রায়ানএয়ার জানায়, ক্রুদেরকে বেলারুশ জানানো হয়; বিমানটিতে নিরাপত্তা হুমকি রয়েছে এবং সেটিকে পার্শ্ববর্তী বিমানবন্দর মিনস্কে অবতরণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
তবে বিমান চলাচল সংক্রান্ত ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডারটুয়েন্টিফোর’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমানটিকে যখন ঘুরিয়ে নেওয়া হয় তখন সেটি আসলে মিনস্কের তুলনায় ভিলনিয়াসের বিমানবন্দরের কাছাকাছি ছিল।
রায়ানএয়ার জানায়, মিনস্কে তল্লাসি চালানোর পর সেখানে অপ্রত্যাশিত কিছু পাওয়া যায়নি এবং স্থানীয় সময় রাত ৮টা ৫০ মিনিটে বিমানটি মিনস্ক ত্যাগ করে। পরিস্থিতি রায়ানএয়ারে নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী যাত্রীদের সবার কাছে অপ্রত্যাশিত বিলম্বের কারণে ক্ষমা চাওয়া হয়। তবে, সংস্থাটি রোমান প্রোতেশেভি ‘র ব্যাপারে কিছু বলেনি।
নেক্সটা-ই প্রথম তাদের সাবেক সম্পাদকের ব্যাপারে খবর দেয়। এতে বলা হয়, বিমান এবং এতে থাকা যাত্রীদের তল্লাশি করার পরই রোমানকে নিয়ে যাওয়া হয়।
বেলারুশের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বেলটা জানায়, রোমান প্রোতেশেভিচকে বহনকারী বিমানটিকে ব্যক্তিগতভাবে বোমা থাকার হুঁশিয়ারি দিয়ে ঘুরিয়ে মিনস্কে অবতরণ করানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন বেলারুশের শাসক আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর। মিগ-২৯ যুদ্ধ বিমান মোতায়েন করার নির্দেশও তার দেওয়া।
১৯৯৪ সাল থেকে বেলারুশ শাসন করছেন লুকাশেঙ্কো। ৬৬ বছর বয়সী এই রাজনৈতিক গত বছর আগস্টের নির্বাচনের পর থেকে ভিন্নমতাবলম্বী ও সমালোচকদের ওপর ব্যাপক দমন–পীড়ন চালাচ্ছেন। অনেক বিরোধী নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন অথবা স্ভেতলানা টিকানোভস্কিয়ার মতো কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। ওই নির্বাচন এবং তার পরবর্তী সময়ে বেলারুশের বিরোধীদের পক্ষে বড় ভূমিকা রেখেছিল নেক্সটা মিডিয়া। টেলিগ্রাম চ্যানেলের পাশাপাশি টুইটার ও ইউটিউবে তাদের খবর প্রকাশিত হয়। এর সিংহভাগ প্রতিবেদন করেন রোমান। পরে তার বিরুদ্ধে লুকাশেঙ্কো সরকার ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনে। যে কারণে ২০১৯ সালে দেশ ছাড়েন তিনি। এরপর নেক্সটা মিডিয়ার মাধ্যমে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের খবর প্রকাশ করেন তিনি।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, বেলারুশ কর্তৃপক্ষ সাংবাদিক রোমানকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে। যদিও রোমানের গ্রেপ্তারের ঘটনায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এবং সেটা বেড়েই চলেছে। বেলারুশে থাকা মার্কিন রাষ্ট্রদূত জুলি ফিশার এক টুইটে বলেছেন, সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের জন্য লুকাশেঙ্কো বোমা থাকার মিথ্যা ভয় দেখিয়ে এবং যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে ন্যাক্কারজনক কাজ করেছেন।
ইউরোপজুড়েও ঘটনাটি নিয়ে নিন্দার ঝড় বইছে। তারা রোমানের দ্রুত মুক্তি এবং পূর্ণ তদন্তের দাবি জানাচ্ছে। লিথুয়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট গিতানাস নসেদা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, বেলারুশের উপর নতুন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে। প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোসহ বেলারুশের অনেক কর্মকর্তার উপরই ইউরোপে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাসহ নানারকম অবরোধ আরোপ করা আছে।
ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডের লিয়েন বলেছেন, ‘এই ন্যাক্কারজনক এবং বেআইনী আচরণের…. পরিণতি ভোগ করতে হবে।’
পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ম্যাতেউজ মোরাউইকি এই ঘটনাকে বলেছেন, ‘নজিরবিহীন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।’ ন্যাটোর মহাসচিব জেন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, ‘এটা মারাত্মক এবং বিপজ্জনক একটি ঘটনা।’
লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া দুদেশই বলছে, বেলারুশের আকাশসীমাকে অনিরাপদ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত। লাটভিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এডগার্স রিনবেভিক্স বলেন, ‘এতে সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করা উচিত।’
বেসামরিক বিমান চলাচল সম্পর্কিত জাতিসংঘের সংস্থা আইকাও বলেছে, এ ধরণের জোরপূর্বক অবতরণের ঘটনায় উদ্বিগ্ন তারা এবং এটি শিকাগো কনভেনশনের লঙ্ঘন হতে পারে। আকাশসীমা এবং বিমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শিকাগো কনভেনশন হয়েছিল।