দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের তীব্রতা কমে আসছে। কয়েক দিন ধরে শনাক্তের হার নিম্নমুখী। তিন সপ্তাহ ধরে চলা ‘লকডাউন’ই সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম পরিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আশা জাগানিয়া এ চিত্রের মধ্যেই ‘লকডাউন’ নিয়ে উল্টোপথে যাত্রা করছে সরকার। আরও কিছু দিন চলাচলে কড়াকড়ি বহাল রাখলে যেখানে সংক্রমণ হয়তো পুরো নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো, সেখানে এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সব কিছু স্বাভাবিক করে দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য শ্রমজীবী মানুষের কাছে করোনার চেয়েও দু’বেলা খাওয়ার জোগানোই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি অর্থনীতিবিদরাও লকডাউনের বিপক্ষে। দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে লকডাউন কার্যকর নয় বলে মনে করেন তারা। তবু সংক্রমণ রোধের স্বার্থে আরও কিছু দিন কড়াকড়ির পক্ষে স্বাস্থ্যবিদরা।
গত ১৪ এপ্রিল শুরু হওয়া এক সপ্তাহের ‘সর্বাত্মক লকডাউনে’ শুধু জরুরি সেবা ও গার্মেন্টস খোলা ছিল। গণপরিবহন, মার্কেট, অফিস, আদালত সব বন্ধ রাখা হয়। পরে লকডাউন আরেক সপ্তাহ বাড়িয়ে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। এ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই দোকানপাট-শপিংমল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজ রবিবার মার্কেট খুলছে। গণপরিবহনও চালুুর চিন্তাভাবনা চলছে। বলা হচ্ছে- সরকার বাধ্য হয়ে লকডাউন শিথিল করছে। কারণ সামনে ঈদ। জীবন-জীবিকার কথা বিবেচনায় রেখে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ ছাড়া সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি অফিসও চালুর ভাবনা আছে সরকারের। তবে শিথিলতা এলেও মাস্ক পরা নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পালনের বিষয়ে সতর্ক থাকবে প্রশাসন।
প্রিভেন্টেটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, লকডাউন যেভাবে দেওয়া হলো, আবার যেভাবে তুলে নেওয়া হচ্ছে- এ প্রক্রিয়াগুলো যথাযথ নয়। লকডাউন তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক ধাপ রয়েছে তা মানা হচ্ছে না। সরকার যে ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা দেখে মনে হচ্ছে, এখানে পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। এর ফলে লকডাউন ব্যর্থতায় পরিণত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, লকডাউনের ফলে দেশে করোনা পরিস্থিতি ভালোর দিকে যাচ্ছিল। এমন সময় আমাদের আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অথচ সরকার লকডাউনের মধ্যেই মার্কেট-দোকানপাট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। ঠিক কী কারণে এমন সিদ্ধান্ত তা আমাদের বোধগম্য নয়। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত।
তিনি আরও বলেন, দেশে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ নেই। আগে ভুল করেও পার পাওয়া গেলেও এবার সহজে পার পাওয়া যাবে না। লকডাউন হলে পরিপূর্ণ লকডাউন হতে হবে। যেমন খুশি তেমন হলে চলবে না। তা থেকে কোনো ভালো ফল পাওয়া যায় না।
চলমান ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ শেষ হচ্ছে আগামী বুধবার। এর আগেই সার্বিক চলাচলে শিথিলতা আরোপ করে প্রজ্ঞাপন দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তবে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নিশ্চিতে জোর দেওয়া হবে।
এটি সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও নিশ্চিত করতে চায় সরকার। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, চলমান সর্বাত্মক লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ ২৮ এপ্রিলের পর শিথিল করা হতে পারে। সরকারি-বেসরকারি অফিস খুলবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি বিবেচনাধীন আছে। প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। আমরা ২৮ তারিখের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে জানিয়ে দেব। সেখানে বিষয়গুলো উল্লেখ থাকবে। ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ শতভাগ বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি আরও বলেন, মানুষ মাস্ক পরবে, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখবে। আগামী কয়েক দিনে সংক্রমণ অনেকটাই কমে যাবে, এটিই স্বাভাবিক। কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানলেই আমরা জীবন ও জীবিকা দুটিই চালাতে পারব।
গতকাল শনিবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, চলমান লকডাউনের পর জনস্বার্থ বিবেচনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে শর্তসাপেক্ষে সরকার গণপরিবহন চালুর চিন্তাভাবনা করছে। গণপরিবহনে অর্ধেক আসন খালি রেখে যে ভাড়া নির্ধারণ ছিল, সেই ভাড়ার অতিরিক্ত নিলে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। বরিশাল সড়ক জোন, বিআরটিসি ও বিআরটিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময়সভায় তিনি এ কথা জানান। কাদের বলেন, লকডাউন শিথিল হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।
আজ রবিবার থেকে খুলছে মার্কেট। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দোকান ও শপিংমল খোলা রাখা যাবে। দোকানপাট খোলার নির্দেশনা এলেও চলাচলের জন্য জনসাধারণের ‘মুভমেন্ট পাস’ নেওয়ার আগের সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা। গতকাল তিনি বলেন, চলাচল নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতার জন্য যেহেতু মুভমেন্ট পাস চালু করা হয়েছে, তা এখনো প্রয়োজন হবে। জরুরি সেবার জন্য যারা জড়িত, তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজন নেই, যেটি আগেই বলা হয়েছে। জরুরি সেবার জন্য যারা জড়িত নয়, তাদের মুভমেন্ট পাস নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেন তিনি।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রোধে কঠোর বিধিনিষেধের দ্বিতীয় ধাপে গত ১৪ এপ্রিল থেকে দেশে জরুরি কাজ ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। পরে এ বিধিনিষেধের মেয়াদ এক সপ্তাহ বাড়িয়ে ২৮ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত করা হয়।
করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় গত ৫ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। দুদিন বাড়িয়ে তা ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। ওই সময় সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানা, গণপরিবহন সীমিত আকারে চালু ছিল। এর পর ১৪ এপ্রিল থেকে শিল্পকারখানা ছাড়া সব বন্ধ রেখে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ দেওয়া হয়। ২৮ এপ্রিলের পর ফের হয়তো সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানা ও গণপরিবহন চালু করা হবে। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য মিলেছে।
চলমান দুই সপ্তাহের লকডাউনে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে পুলিশের বেশ কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে রিকশাচালকদের প্রতি পুলিশের আচরণ ছিল খুবই মারমুখী। মোটা অঙ্কের জরিমানা করা, রিকশা কেড়ে নেওয়া, চাকা লিক করে দেওয়া, সড়কের ওপরে রিকশা উল্টিয়ে রাখা ইত্যাদি ঘটনা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। গরিবের ওপর এমন ‘অত্যাচারে’ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে ফেসবুকে। লকডাউন তুলে দেওয়ার বিষয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদরাও সোচ্চার।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। বাকি ৮৫ শতাংশ সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু দারিদ্র্যের কশাঘাতে অপুষ্টির শিকার হলে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে অনেককে। তিনি আরও বলেন, লকডাউনে সচ্ছল ধনী মানুষ তার বড় বাসায় সোশ্যাল ডিসটেন্স (দূরত্ব) মানতে পারে, কিন্তু ঝুপড়িঘরে থাকা মানুষ লকডাউনে একে অন্যের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হয় দিনের বেশিরভাগ সময়। তারা স্বাস্থ্যবিধি মানবে কীভাবে?
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, লকডাউন দিলে মৃত্যুঝুঁকি কমানোর শান্তিতে থাকে সচ্ছল মানুষ। কিন্তু ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভোগা মানুষের জন্য লকডাউন কোনো শান্তির বার্তা আনে না। বরং তারা করোনার ঝুঁকি নিতে রাজি, কিন্তু ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভুগতে রাজি নয়। ধনী দেশগুলোর পক্ষে লকডাউন কার্যকর করা সম্ভব, কিন্তু স্বল্পআয়ের দেশে লকডাউন কার্যকর করা কঠিন। তাই স্বল্পোন্নত দেশে লকডাউন দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো যাবে না। করোনার কারণে শিক্ষায় যে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তাতে ভবিষ্যৎ আয় বৈষম্য আরও বাড়তে পারে বলেও মনে করেন ড. নাজনীন আহমেদ।