ইন্ডিয়ান, ব্রাজিলিয়ান, দক্ষিণ আফ্রিকান এবং বৃটিশ করোনা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট। বর্তমানে জ্ঞাত এসব করোনা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বকে নতুন করে আতঙ্কিত করে তুলেছে। করোনা ভাইরাসের নতুন এক রূপান্তর, যা প্রথমে পাওয়া গিয়েছিল ভারতে, তা এখন বৃটেনেও শনাক্ত করা হয়েছে। ভারত বর্তমানে করোনা ভাইরাস এবং এর ভ্যারিয়েন্টে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশের প্রতিবেশী এই দেশের এই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে তাই সবারই মাথা ঘামা শুরু হয়েছে। অনলাইন বিবিসিতে স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক মিশেলে রবার্টস লিখেছেন, স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা ভাইরাস তার জেনেটিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এর অর্থ হলো মূল ভাইরাসের চেয়ে অন্যান্য স্ট্রেইন আরো অধিক সংক্রামক। বলা হচ্ছে অতীতের সংক্রমণ বা বর্তমানের টিকা এক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না।
কিন্তু বিষয়টি নিশ্চিত হতে আরো অনেক গবেষণা করার প্রয়োজন আছে।
ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে যা জানা গেছে
ভাইরাসের হাজার হাজার সংস্করণ বা ভ্যারিয়েন্ট আছে। করোনা ভাইরাসেরও তাই। এর মধ্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে ব্রাজিলিয়ান, দক্ষিণ আফ্রিকান ও বৃটিশ ভ্যারিয়েন্ট। তবে একই রকম উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো পর্যাপ্ত তথ্য এখনও পরিষ্কারভাবে মিলছে না ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের (পিএইচই) ড. সুসান হপকিন্স বলেন, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট কত বেশি সংক্রমণযোগ্য সেটা আমাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে জানা প্রয়োজন। আরো জানা দরকার এটা কত বেশি ভয়াবহ এবং কতটা টিকার বিরুদ্ধে কাজ করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা এমন তথ্য পরিষ্কারভাবে হাতে পাইনি। ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত বৃটেনে নিশ্চিতভাবে ৭৭ জনের দেহে ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৬১৭) শনাক্ত করা হয়েছে। পিএইচই বলেছে, এতে দৃশ্যত কিছু ঘটনা আন্তর্জাতিক ভ্রমণের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তাহলে কিভাবে তা সংক্রমিত হলো তা নির্ধারণের জন্য অনুসন্ধান চলছে। এরই মধ্যে এ মাসের শেষের দিকে পূর্ব নির্ধারিত ভারত সফর বাতিল ঘোষণা করেছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এ খবর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব মিডিয়া লুফে নিয়েছে।
বৃটিশ, ব্রাজিলিয়ান, দক্ষিণ আফ্রিকারন ভ্যারিয়েন্ট কি
এখন পর্যন্ত জানা তথ্যে এসব ভ্যারিয়েন্ট অধিক মাত্রায় সংক্রামক। করোনা ভাইরাসের এসব ভ্যারিয়েন্ট রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে আক্রমণ করে। বর্তমানে বৃটেনে যে ভ্যারিয়েন্ট বেশি সংক্রামক হয়ে উঠেছে তা হলো ইউকে বা কেন্ট ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭)। এই ভ্যারিয়েন্ট কমপক্ষে ৫০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দৃশ্যত এই ভ্যারিয়েন্ট আবারও তার রূপান্তর ঘটাতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৩৫১) বৃটেনসহ কমপক্ষে ২০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (পি১) শনাক্ত করা হয়েছে বৃটেনে। এসব ভ্যারিয়েন্ট যে এরই মধ্যে আবার রূপান্তরিত হয়নি তা বলা যাবে না। সব ভাইরাসই এমনভাবে বিবর্তিত হয়। তারা নিজেদের বিস্তার ঘটানোর জন্য নিজেদেরকেই কপি করে। তবে তাদের মধ্যে পার্থক্য খুব কম। এর মধ্যে টিকে থাকার জন্য কিছু ভাইরাস ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। আবার কিছু অধিক সংক্রামক এবং হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
নতুন ভ্যারিয়েন্ট কি অধিক বিপজ্জনক
যেসব মানুষ এসব ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হন তার মধ্যে কিছু মানুষ যে ভয়াবহ অসুস্থতায় ভুগতে পারেন তেমন প্রমাণ মেলেনি। মূল করোনা ভাইরাসের মতোই এসব ভ্যারিয়েন্ট বয়স্ক এবং যারা স্বাস্থ্যবিধি মানেন না তাদের জন্য ঝুঁকি হিসেবে দেখা হয়। বৃটিশ ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। তা থেকে দেখা যাচ্ছে শতকরা ৩০ ভাগ বেশি মৃত্যুর সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। তবে এখন পর্যন্ত এই তথ্য প্রমাণিত নয়।
কিভাবে নতুন ভ্যারিয়েন্ট রূপান্তরিত হয়
যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল এবং ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট- এরা সবাই তাদের প্রোটিন স্পাইকগুলো পরিবর্তন করেছে। আমরা করোনা ভাইরাসের গায়ে কাঁটার মতো যেসব জিনিস দেখতে পাই, সেটাই প্রোটিন স্পাইক। এর সাহায্যে এই ভাইরাস মানুষের কোষের সঙ্গে যুক্ত হয়। এসব ভাইরাসের একটি অভিন্ন রূপান্তর হয়। একে বলা হয় এন৫১ওয়াই। এর ফলে রূপান্তরিত ভাইরাস কোষের মধ্যে আরো ভালভাবে সংক্রমণ ঘটাতে পারে এবং এর বিস্তার হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বৃটিশ/কেন্ট স্ট্রেইন মূল ভাইরাসের চেয়ে শতকরা ৭০ ভাগ বেশি সংক্রমণযোগ্য। তবে পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের গবেষণায় এই সংক্রমণকে শতকরা ৩০ ভাগ থেকে ৫০ ভাগ বেশি বলে দেখা গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্টের আরো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে প্রোটিন স্পাইকে। তাদের যে মূল রূপান্তর হয় তাকে বলা হয় ই৪৮৪কে। এর ফলে এই ভাইরাসকে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেয়ার সক্ষমতা দান করে। এর অর্থ হলো যেসব মানুষ আগে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন অথবা টিকা নিয়েছিলেন, তারা তাদের শরীরে তৈরি হওয়া এন্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে পারেন না। বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি দেখতে পেয়েছেন বৃটেনে অল্প সংখ্যক ক্ষেত্রে বৃটিশ ভ্যারিয়েন্টে এই পরিবর্তন ঘটছে। অন্যদিকে ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টে গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর ঘটে। এগুলো হলো ই৪৮৪কিউএল৪৫২আর এবং পি৬৮১আর।
ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কি টিকা কাজ করছে
বর্তমান ভ্যারিয়েন্টগুলো টিকা বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে কোষে আক্রমণ করতে পারে। তবু বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, যেসব টিকা দেয়া হচ্ছে তা কাজ করছে, যদিও সব রোগী হয়তো পুরোপুুরি সুস্থ হচ্ছেন না। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষের এরই মধ্যে করোনা হয়েছিল অথবা তাদের শরীরে কোনো না কোনোভাবে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে, তাদের এন্টিবডির বিরুদ্ধে কাজ করে ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট। তবে ল্যাবরেটরির পরীক্ষা এবং বাস্তব ডাটার ওপর ভিত্তি করে এটা বলা হয়েছে যে, নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে ফাইজারের টিকা, তবে কার্যকারিতা হয়তো সামান্য কম হতে পারে। অন্যদিকে অক্সফোর্ড/এস্ট্রাজেনেকার টিকা বিষয়ক টিমের ডাটা বলছে, এই টিকা বৃটিশ নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ভাল সুরক্ষা দিয়ে থাকে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কম সুরক্ষা দেয়। খুব বেশি আক্রান্তদেরকে এখনও সুরক্ষা দেয় এই টিকা। প্রাথমিক তথ্যে দেখা গেছে মডার্নার টিকা দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর, যদিও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী বা দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে।
অন্যদিকে অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করছে করোনা ভাইরাসের আরো দুটি টিকা। তা হলো নোভাভ্যাক্স এবং জ্যানসেন। এ দুটি টিকাও নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কিছুটা সুরক্ষা দেয় বলে মনে করা হয়।