বাদশাহ নামদার: একটু কথা ছিল!

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


যুক্তরাজ্য থেকে ডা: আলী জাহান

১. ঢাকার ব্যস্ততম এলাকার একটি হচ্ছে কাকরাইল। ইসলামী ব্যাংকের একটি শাখা ছিল ওখানে। ব্যাংকের কাজে একদিন ভেতরে কয়েক ডজন গ্রাহক অপেক্ষা করছেন। কেউ কেউ ভেতরে জায়গা না পেয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের ভেতরে আমিও ছিলাম একজন।

২. হঠাৎ করে বাইরে শোরগোল হচ্ছে। ইটপাটকেল ছোড়া হচ্ছে। হঠাৎ পুলিশ বা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। কী হচ্ছে তা দেখার জন্য ভেতর থেকে কেউ কেউ জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছেন।
কেউ কেউ দৃশ্যটি ভালোভাবে উপভোগ করার জন্য দরজার পাশে চলে এসেছেন। কিন্তু সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা দুই ভদ্রলোক গ্রাহকদের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য অনুরোধ করছিলেন। সম্ভবত কলাপসিবল গেইট লাগিয়ে দেয়ার প্ল্যান ছিল। বাঙালি তো সহজে কথা শুনবে না। কেউ কেউ সিকিউরিটির কথা অগ্রাহ্য করে বাইরে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখতে লাগলেন। ভেতর থেকে ব্যাংকের কয়েকজন কর্মচারী/কর্মকর্তা এগিয়ে আসলেন। তাদের ভেতরে ওই শাখার ম্যানেজার ছিলেন। তিনি এসে গ্রাহকদের খুব মিনতি করে বললেন ‘ প্লিজ, আপনারা ভেতরে প্রবেশ করুন। আপনাদের নিরাপত্তা এবং ব্যাংকের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা গেইট লাগিয়ে দেবো। দয়া করে যারা ব্যাংকে এসেছেন তারা ভেতরে প্রবেশ করুন।’ ম্যানেজারের গলায় উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা ছিল। চেহারায় একটা কাচুমাচু ভাব ছিল। তবে সেইসাথে গ্রাহকদের প্রতি তাঁর সম্মানবোধ ছিল। তাই তিনি তাদেরকে অনুরোধ করছিলেন ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। আমি সহ অনেকেই তার অনুরোধ ফেলতে পারিনি। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলে কলাপসিবল গেইট লাগিয়ে দেয়া হয়।

৩. ভদ্রলোকের সৌজন্যবোধ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। কারণটা তৎক্ষণাৎ না বুঝলেও পরে কিছুটা বুঝতে পারি। বিষয়টি হচ্ছে যে, তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করেন। গ্রাহকদের প্রজা বা গোলাম হিসেবে দেখেন না। তিনি জানেন যে, তার চাকরি এই ব্যাংকের ভবিষ্যতের সাথে জড়িত। সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে রাজকীয় ভাব নিয়ে চলতে পারেন তা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সেই কারণেই হয়তো তিনি এতোটা ভদ্র ছিলেন। এমনও হতে পারে ভদ্রলোক আসলেই ভদ্র। হতে পারে পারিবারিক বা ধর্মীয় শিক্ষা তাঁর সেই ভদ্রতাবোধ তৈরীতে অবদান রেখেছিল। ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেবের ব্যবহার এখনও আমার মনে আছে।

৪. ব্যাংকের ওই ভদ্রলোক নিজেকে বাদশাহ নামদার মনে করেননি। আমার মনে হয় বাংলাদেশে অধিকাংশ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের বাদশাহ নামদার ভাবার সুযোগ কম পান। এর একটি কারণ হতে পারে যে তারা ভয়ে থাকেন তাদের চাকরি যে কোন সময় চলে যেতে পারে এবং তাদের গতিবিধি কঠোরভাবে মনিটর করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। কোম্পানি না থাকলে ওনাদের চাকরি থাকবে না, ওনারাও টিকবেন না।

৫. অবশ্য সরকারি চাকরি করলে আপনার (কারো কারো ) ভেতর একটা হামবড়া ভাব চলেই আসতে পারে। আপনি ভালোভাবে জানেন যে সরকার আপনাকে সহজে চাকুরিচ্যুত করতে পারবে না। আপনার নেতা আছেন, ট্রেড ইউনিয়ন আছে, সর্বোপরি রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে। আপনাকে সহজে চাকরিচ্যুত করতে পারবে না। তাই আপনি হয়তো সাধারণ জনগণকে প্রজা হিসেবে ভাবেন। মুখে যা আসে তাই বলেন। আপনাদের কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না। আপনারা আসলেই বাদশাহ নামদার!

৬. বাদশাহ নামদারদের সংখ্যা কতো বাংলাদেশে? সবাইকে আমরা চিনি? না, সবাইকে আমরা চিনি না বা চেনা সম্ভব নয়। তবে মাঝেমধ্যে সেই বাদশাহ নামদারদের কারো কারো উক্তি পত্রিকায় আসে। আমরা সেই উক্তি পড়ি। কেউ কেউ এড়িয়ে যান। কেউ কেউ বসে চিন্তা করেন ‘আমরা প্রজা হলাম কবে থেকে?জমিদারি প্রথা আবার আসলো কীভাবে?’ উনারা শুধু চিন্তা করেন কিন্তু কিছু বলেন না। বলতে গেলেই হয়তো দরজায় মাঝরাতে কেউ কড়া নাড়বে। হয়ে যেতে পারেন চিরদিনের জন্য গুম বা নিস্তব্ধ।

৭. করোনা লকডাউন নিয়ে একটি ভয়াবহ অবস্থা হচ্ছে বাংলাদেশে। এই হট্টগোলের ভেতরে এক বাদশাহ নামদার ২ দিন আগে একটি ‘বাণী’ দিয়েছেন। উনি বলেছেন ‘লকডাউনের সময় আপনাদের কাউকে রাস্তায় দেখতে চাই না’! একটু দাঁড়ান। আবার শব্দগুলো পড়ে নেই। শব্দগুলো মনোযোগ সহকারে আবার পড়লাম। ভুল পড়ছিনাতো? নাহ, আমি ভুল পড়িনি। ‘আপনাদের কাউকে রাস্তায় দেখতে চাই না’। প্রজাতন্ত্রের একজন চাকর এই উক্তি করেছেন! জনগণের সেবক জনগণকে উদ্দেশ্য করে এই কথা বলেছেন! প্রশ্ন হচ্ছে, উনি কি এমন উক্তি করতে পারেন? জনগণের ট্যাক্সে যার বেতন হয়, ইউনিফর্ম হয়, গাড়ি হয়, বাড়ি হয়, স্ট্যাটাস হয়- সেই জনগণকে তিনি এভাবে, এই ভাষায় হুমকি দিতে পারেন? শব্দগুলো খেয়াল করুন…. দেখতে চাই না.. দেখতে চাই না..! বাদশাহ নামদারের ফরমান মনে হচ্ছে না?

৮. কাকরাইলের ব্যাংকের সেই ম্যানেজারের কথা মনে পড়ে গেল। গ্রাহকদের ভেতরে নিয়ে আসার জন্য তার কণ্ঠে কাকুতি-মিনতি ছিল। তিনি গ্রাহকদের হুমকি দেন নি। ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে বলেছেন।তাতেই গ্রাহকরা ওনার কথা মানতে রাজি হয়েছে। ভাবছি উনি যদি আমাদের এই জামানার বাদশাহ নামদারের মতো বলতেন… আপনাদের আমি দরজায় দেখতে চাই না, আপনাদের আমি আমার ব্যাংকের বারান্দায় দেখতে চাই না… উনার চাকুরী কি এখনো বহাল থাকতো? আপনাদের প্রতিক্রিয়া কী হতো?

ডা: আলী জাহান
কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট
যুক্তরাজ্য
[email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *