খাবার না থাকা মানুষকে ঘরে রাখা কঠিন হবে

Slider টপ নিউজ


করোনা ভাইরাস সংক্রমণে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি কমাতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। তবে কোনো কিছুতেই করোনার প্রকোপ কমানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য অনুযায়ী, মানুষের অবাধ যাতায়াত এবং সামাজিক দূরত্বসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি না মানার ফলেই দেশে করোনা সংক্রমণ বেড়েছে। ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই সরকারকে লকডাউনে যেতে হয়েছে। গত ৫ এপ্রিল এক সপ্তাহের জন্য জনসাধারণের

চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। পরে এই বিধিনিষেধের সময় আরও দুদিন বাড়ানো হয়। এবার নতুন করে আজ বুধবার থেকে পুনরায় আট দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হচ্ছে। এ সময় সরকারি-বেসরকারি সব অফিস আদালত বন্ধ থাকবে।

এবার লকডাউনে মানুষকে ঘরে রাখতে প্রশাসনের কঠোর হওয়ার আভাস মিলেছে। তবে শ্রমজীবী মানুষ অর্থাৎ দিন আনে দিন খায় এমন মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে তাদের ঘরে রাখা কঠিন হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ আগের লকডাউনগুলো খুব একটা কার্যকর দেখা যায়নি। ফলে করোনা সংক্রমণ তো কমেইনি; বরং মানুষের হাহাকার বেড়েছে। এবারের লকডাউন সফল করতে প্রশাসনকে বেশ চ্যালেঞ্জ পোহাতে হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, লকডাউন কার্যকরের আগে গ্রামে ছুটছে সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন বাস টার্মিনালে উপচেপড়া ভিড়। যদিও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ। মানুষ ট্রাক-পিকআপে চড়েই বাড়ির পথে ছুটছে। এ ছাড়া ফেরিঘাটগুলোতেও লেগে ছিল প্রচ- ভিড়। যে যেভাবে পেরেছে ঢাকা ছেড়েছে গতকাল। ফলে ঢাকা শহর মোটামুটি ফাঁকা বললেই চলে। যদিও সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল যে যেখানে আছে, যেন সেখানেই থাকে। কিন্তু সরকারের এমন আহ্বানে সাড়া দেয়নি মানুষ। এবার ‘সর্বাত্মক লকডাউনের’ মধ্যে অতি জরুরি প্রয়োজনে চলাফেরায় পুলিশের ‘মুভমেন্ট পাস’ নিতে হবে। এই পাসধারী ব্যক্তি ঢাকার ভেতরে ও বাইরে- সড়কে নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারবেন। গতকাল দুপুরে ‘মুভমেন্ট পাস’ অ্যাপ্লিকেশনটি উদ্বোধন করা হয়।

গত বছর সংক্রমণের প্রথম ঢেউ মোকাবিলায় ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এবার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় দুই দফায় ২৯ মার্চ ও ৪ এপ্রিল কিছুটা ‘নরম’ বিধিনিষেধ জারি করা হলেও তাতে সুফল মেলেনি। এসব বিধিনিষেধের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা রেকর্ড গড়েছে।

গত বছর ‘লকডাউনে’ প্রথম দিকে গার্মেন্ট বন্ধ থাকলেও এবার গার্মেন্টসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা খোলাই থাকছে। দেশের অর্থনীতি ও মালিকদের অনুরোধে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে একবারেই ‘দিন আনে দিন খায়’ এমন মানুষদের জন্য এবারের লকডাউনে সরকারের তরফ থেকে কোনো সহায়তার ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি। ফলে ঘর থেকে বের হতে না পারলে কিভাবে দুবেলার খাবার জোটাবেন তা নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। এজন্যই এবার অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদরা লকডাউনের পরিবর্তে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের কথা বলছেন।

অপরিকল্পিত লকডাউন অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম রব। তিনি বলেন, করোনার ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। যেভাবে প্রতিদিন করোনায় মৃত্যু এবং সংক্রমণের বিস্তার ঘটছে, তা যথাযথ মোকাবিলা ব্যর্থ হলে চরম বেদনাদায়ক অবস্থার সৃষ্টি হবে। এখনো যদি সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে আগের মতো আত্মতুষ্টিতে ভুগতে থাকে, তা জাতির জন্য চরম দুর্দিন বয়ে আনবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক নাজনীন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, সত্যিকার অর্থে আমরা আর লকডাউন বা সাধারণ ছুটি চাচ্ছি না। কারণ বাংলাদেশের মতো একটি দেশে লকডাউন দিয়ে জীবিকা বাঁচে না, বাঁচে না জীবনও। এখানে দরকার স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে সবকিছু খোলা রাখা। সাধারণ ছুটিতে লোকজন বেকার বসে থাকলে অন্যান্য দেশের মতো ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছানো বা নগদ টাকা দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই। সুতরাং লকডাউন বা সাধারণ ছুটি নিম্নআয়ের মানুষকে মহাসংকটে ফেলবেই। তিনি আরও বলেন, যদি সরকারকে লকডাউনে যেতেই হয় তা হলে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। গতবার মানুষের হাতে সঞ্চয় ছিল, এখন কিন্তু স্বল্প আয়ের মানুষের হাতে সঞ্চয় কম। কাজেই সত্যিকারের লকডাউনে গেলে অনেক বেশিসংখ্যক মানুষের সাহায্য দরকার হবে। এত মানুষের দায়িত্ব নেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সক্ষমতা আমাদের আছে কি?

নাজনীন আহমেদ আরও বলেন, টানাটানিতে চলা লোকজন কারও কাছে হাত পাততে পারবেন না। কিন্তু খাদ্য কষ্টে থাকবেন। এদেরও কিন্তু সরকারি সাহায্যের প্রয়োজন হবে। আবারও বলছি, গত বছর এ সংকটে মানুষ যতটা না পড়েছে, এবার তার চেয়ে বেশি হবে। কারণ অনেক মানুষের সঞ্চয় একেবারেই নেই। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য খাদ্য বা আয়ের নিরাপত্তা বা কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা দেওয়ার উপায় কী হবে?

তিনি বলেন, আমার পরামর্শ সব ধরনের সভা-সমাবেশ জনসমাগম বন্ধ করে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানা নিশ্চিত করতে হবে। সংক্রমণ প্রতিরোধমূলক মাস্ক, সাবান ইত্যাদি ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। এ সংক্রান্ত প্রচার জোরদার করতে হবে। স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় গ্রামপর্যায়ে পর্যন্ত সচেতনতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি স্বাস্থ্যবিধি মানা কঠোরভাবে ইমপ্লিমেন্ট করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *