ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতার প্রথম সোপান

বাধ ভাঙ্গা মত


ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের পর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ইন্দো-পাক বিভক্ত হয়ে যায়। ইন্দো- পাক বা পাক-ভারতের বিভক্তিতে ভৌগোলিক ব্যবধানের কারনে পাকিস্তানের দুটি অংশ সৃষ্টি হয়। একটি হলো পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ ও অন্যটি হলো পশ্চিম পাকিস্তান বর্তমান পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালির প্রতি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানা, যা পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা শুরুতেই উপলব্ধি করতে শুরু করে। মূলতঃ এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল গোঁড়া ধর্মীয় ভিত্তির ওপর নির্ভর করে । পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী তাঁদের নিজেদের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার গভীর চক্রান্তে লিপ্ত হলো, এমনকি উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের সব বিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা করার দাবী ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন সচেতন নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে।

১৯৪৮-এর ১ মার্চ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রদত্ত বিবৃতিতে ১১ মার্চের হরতাল যেকোনো মূল্যে সফল করার আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান, তমদ্দুন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম, মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদিন আহমেদ ও আবদুর রহমান চৌধুরী। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে কেন্দ্র করে অন্যান্য রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে নবগঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিশ, মুসলীম ছাত্রলীগ, কমিউনিস্টপার্টি সমর্থিত ছাত্র ফেডারেশন এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগসহ আরও ২/৩টি সংগঠন রাষ্ট্রভাষার পক্ষে তৎপর হয়ে উঠে। ৪৮ সনের ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। বাংলা ভাষার দাবিতে এই কমিটি বিক্ষোভ সমাবেশ চালাতে থাকে।এরপর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তারিখে ঢাকাতে প্রথম হরতালের ডাক দেয়।

১১ মার্চ সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এই হরতাল প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চিন্তাকে নাড়া দেয়। এই হরতাল চলাকালে শেখ মুজিব পুলিশি হামলায় আহত ও গ্রেপ্তার হন। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা অলি আহাদ তাঁর লিখিত গ্রন্থে উল্লিখিত ঘটনায় শেখ মুজিবের সাহসী ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। সম্ভবত শেখ মুজিবই প্রথম রাজবন্দি, যিনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে মাতৃভাষা আন্দোলনের জন্য সর্বপ্রথম গ্রেপ্তার হন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ১৯৪৮-এর ১৫ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের আট দফা চুক্তি অনুসারে শেখ মুজিবসহ অন্য ভাষাসংগ্রামীরা কারামুক্ত হন। ভাষাসংগ্রাম আরো তীব্র করার লক্ষ্যে ১৬ মার্চ (৪৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা থেকে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে (পুরনো জগন্নাথ হল ছাত্রাবাস) বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় ভাষাসহ অন্যান্য দাবি পেশ করার লক্ষ্যে।

পর দিন ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুসারে ওই দিন দেশব্যাপী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূলত ভাষার দাবিতে সফল ধর্মঘট পালিত হয়। দৃঢ় প্রত্যয়ী এবং আন্দোলন প্রশ্নে অবিচল শেখ মুজিব ক্রমেই ছাত্র-যুবসমাজের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই ১৭ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট সফল ভাবে পালিত হয়। অপরদিকে পাকিস্তান সরকারও দমননীতির আশ্রয় নিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৪৪ ধারা ভেদ করে হরতালের স্বপক্ষে পিকেটিং করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে যান তৎকালীন ভাষা সংগ্রামী শেখ মুজিবুর রহমান, শামছুল হক,অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রনেশ দাস গুপ্তসহ আরও অনেকে। অন্যদিকে গোটা ঢাকাব্যপী চলতে থাকে ব্যাপক পুলিশী লাটিচার্জ ও ধরপাকড়। তারপরও গণজোয়ার ও বিক্ষোভ বাড়তে থাকে। এহেন পরিস্থিতিতে এবং গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন পূর্ব পাকিস্তান সফরকে নির্ভেজাল করার লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ‘রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ নেতৃবৃন্দের সাথে একটি রফায় পৌছেন এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে কার্যকর করার আশ্বাস প্রদান করেন। তাতে আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য আসলেও তার পরিতৃপ্তি পরবর্তীতে নষ্ট হয়ে যায় ঢাকায় আলী জিহ্নার আগমনে। আলী জিন্নাহ ঢাকাতে এসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিলেন urdu and urdu shall be the state language of pakistan। এতে হতাশার সাগরে ডুবে যায় পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষাকামী শান্তিপ্রিয় নেতৃবৃন্দ। পাশাপাশি ক্ষোভও বাড়তে থাকে পূর্ববঙ্গের সর্বস্তরের মানুষের মনে। ঢাকা সফরকালেই মোঃ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানের চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদের বাসায় ভাষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন একাধিক ভাষা রাষ্ট্রীয় সংহতির জন্য ক্ষতিকর। তিনি বলেছিলেন For the interest of the integrity of pakistan, if necessary, you hare to change youre mother tounge. তাতে নেতৃবৃন্দ আশাহত হলেন। নেতৃবৃন্দ অত:পর ইংরেজিতে লিখিত একখানা স্মারকলিপি জিন্নাহর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সে বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে জিন্নাহর মৃত্যু হয়।খাজা নাজিমুদ্দিন গভর্নর জেনারেল এবং পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হন নুরুল আমীন। ১৯৪৮ সনের নভেম্বর মাস।প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ছাত্র সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। এরপর বাংলা ভাষার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটি স্মারকলিপিও প্রদান করেন। কিন্তু লিয়াকত আলী খান তাতে গুরুত্ব না দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলে তারই নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন ছাত্রদের উপর পুলিশ ও গুন্ডা লেলিয়ে দেন। শুরু হয় বাঙালিদের উপর চরম জুলুম অত্যাচার। এর প্রতিবাদে বিপরীতক্রমে ছাত্র সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসময় ছাত্র আন্দোলনে ইন্ধন প্রদানের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল ১৯৪৯ সনের মার্চ মাসে ২৪ জন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করে। তন্মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, মোল্লা জালালুদ্দিন, দেওয়ান মাহবুব আলী, নুরুল ই সালাম চৌধুরী, আব্দুস সামাদ, নইমুদ্দিন আহমদ প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য।

১৯৪৯ সনের ১৯ এপ্রিল তারিখে বাংলা ভাষার দাবীতে পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষার পক্ষে গণ জাগরণ সৃষ্টির নেতৃত্বের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ধর্মঘট পালনকালে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। একই সময়ে ধরপাকড়ের ফলে অলি আহাদ, আবুল মতিন, নিতাই গাঙ্গুলি, এনায়েত করিম, খালেক নেওয়াজ খান, মাযহারুল ইসলামসহ অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়। তখন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে চলছিলো ষড়যন্ত্র এবং ক্ষমতার পালাবদলের খেলা। জিন্নাহর জীবদ্দশায় ক্ষমতার রশি টানাটানি নিয়ে জিন্নাহ-লিয়াকত সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিলো। জিহ্নার মৃত্যুর পর পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী থেকে গভর্নর জেনারেলের পদে আসীন হলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। প্রধানমন্ত্রীর পদে লিয়াকত আলী খান তখন দুর্দান্ত প্রতাপের অধিকারী। কিন্তু আততায়ীর গুলিতে লিয়াকত আলী খান নিহত হবার পর খাজা নাজিমুদ্দিন হয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। এই প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকেই খাজা নাজিম উদ্দিন তার অতীত অঙ্গীকার তথা বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানকে বেমালুম ভুলে গিয়ে পশ্চিমা প্রভুদের সুর কণ্ঠে ধারণ করলেন। এরপর ১৯৫২ সনের ২৭ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত ঢাকার পল্টনে এক জনসভায় ঘোষণা দিলেন-উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪৮ সনের সরকারি উদ্ধৃত উক্তি এবং ৫২ সনের উক্তিতে কোন তফাৎ আর রইলোনা। কিন্তু ততদিনে পদ্মা মেঘনায় বয়ে যায় প্রবল স্রোত। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে জন্ম নেয়া তখনকার ধর্মীয় আবেগের আচ্ছন্নতা ভেঙে যায় আসন্ন বাস্তবতার ধাক্কায়। বাঙালি ধর্মীয় আবেগ ঝেড়ে ফেলে বাঙালি পরিচয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেদেরকে প্রতিবাদী করে গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘোর কেটে যাওয়ায় সৃষ্টি হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ। মাওলানা ভাসানী, শামছুল হকসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবর্গ প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে পূর্ব বঙ্গবাসীর আত্মনিয়ন্ত্রণ আকাঙ্ক্ষাকে চাঙ্গা করতে সক্ষম হন। ছাত্র সমাজের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ সমাবেশ। ধারাবাহিকভাবে তা চলতে চলতে একসময় রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে নতুনভাবে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ যার আহ্বায়ক করা হয় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে। একই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আব্দুল মতিনকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ঢাকাসহ প্রদেশব্যাপী আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে অবিরাম গতিতে। ভাষা আন্দোলনকে চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। সরকারও পরিস্থিতি মোকাবেলায় মরিয়া হয়ে উঠে এবং ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার নবাবপুরে মুসলিম আওয়ামী লীগ অফিসে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের মিটিং ডাকা হয়েছিলো। কিন্তু এ সময়ে সাংগঠনিক সফরে মাওলানা ভাসানী ছিলেন ঢাকার বাহিরে এবং শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে। তাই খেলাফতে রব্বানী পার্টির সভাপতি আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় রাজনৈতিক নেতৃবর্গ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় মিটিংটি সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় শেষ হয়েছিলো। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সংগ্রামী ছাত্রছাত্রীদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে। এরপর ঐদিন বেলা ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যুবলীগ নেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে মিটিং শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সহসা পুলিশ উপস্থিতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এসময় আওয়ামী মুসলিমলীগ সম্পাদক শামছুল হক ও যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে আহ্বান জানান। তাদের আহ্বানে সহমত পোষণ করেন কাজী গোলাম মাহবুব ও ছাত্রলীগ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান। তাতে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এ বিভ্রান্তির ঘোর কেটে যায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা আব্দুল মতিনের তেজোদীপ্ত ভাষণে।

সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তের নিন্দাজ্ঞাপন করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ শুরু হয়। ৬/৭ জনের গ্রুপবদ্ধ হয়ে সংগ্রামী ছাত্র ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় ফটক অতিক্রম করতে থাকে। এসময় পুলিশের হাতে বন্দী হয় অনেকে। এদিকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অত্যন্ত পরিকল্পিত পন্থায় পুলিশের উপর ইট পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পুলিশ বাহিনী বিভিন্ন অজুহাত খোঁজে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় ঢুকে পড়ে। বিপর্যস্ত পুলিশ অবস্থা বেগতিক জানালে ঢাকার ডিসি কোরাইসীর নির্দেশে তারা মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ শুরু করে। সংবাদ পৌঁছে যায় কারাগারে। শেখ মুজিবুর রহমান কারার মধ্যেই অনশন শুরু করেন পাক সরকারের এ অমানুষিক সিদ্ধান্তের এবং কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে। পুলিশের গুলি বর্ষণ চলতে থাকলে বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতার মিছিলটি কিছুটা ছত্রভঙ্গ পরিস্থিতিতে ঢাকা মেডিকেলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এসময় এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণে ঘটনাস্থলে নিহত হন আবুল বরকত, জব্বার সহ অনেকেই। এ নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন ত্যাগ করে মৌলানা তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, আবুল কালাম শামছুদ্দিন, আনোয়ারা খাতুনসহ কংগ্রেস দলীয় সংসদ সদস্যরা ভাষা আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা শহর ফুঁসে উঠে। পরিস্থিতি বেসামাল দেখে সরকার ঢাকা শহরে সান্ধ্য আইন জারি করে। পরদিন সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গনে লাখো জনতার উপস্থিতিতে নিহতদের উদ্দেশ্যে গায়েবী জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লাখো জনতার মিছিল রাজপথে নামে বিক্ষোভ সহকারে প্রচন্ড ক্ষিপ্রতায়। জনতা নুরুল আমীনের মালিকানাধীন সংবাদ পত্রিকা অফিসে হামলা চালায় এবং মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দেয়। ঐদিন পুলিশের গুলিতে আব্দুস সালাম ও শফিউর রহমান নিহত হন।

’৫২ সনের ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা কেউ কেউ ১১ জন উল্লেখ করলেও জানা যায় এ সংখ্যা আরও বেশী ছিলো। পুলিশ হাসপাতাল মর্গ থেকে কয়েকটি লাশ গুম করে দেয়ায় তারা রয়ে গেছেন শনাক্তের বাইরে। ভাষার দাবিতে শহীদের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হবার পর তার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। তাই প্রতিবাদী হয়ে উঠে গোটা দেশের ছাত্র জনতা। পরিস্থিতি সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এমন আশংকায় নুরুল আমীন সরকার পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে প্রস্তাব পাশ করে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে পাঠাতে বাধ্য হয়। সাংবিধানিকভাবে ১৯৫৬ সালে সংবিধানের ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালি জাতির চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।

ভাষা আন্দোলনের গাম্ভীর্য্যতা, তার দর্শন ও প্রকৃতি বিবেচনা করে ১৯৯৯ সনের ১৭ ডিসেম্বর ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য অর্থাৎ বাঙালিদের জন্য এক পরম পাওয়া। আত্মত্যাগ কোনদিনই বৃথা যায় না-এ সত্যটুকু প্রতিভাত হয়েছে এ স্বীকৃতির মাধ্যমে।

নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও এর স্থলে সংখ্যালঘু মাত্র ৫ শতাংশের ভাষা উর্দুকে অযৌক্তিক ও অনৈতিকভাবে চাপিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালি ক্রমেই ঐক্যবদ্ধ হয়। মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় বায়ান্নতে রক্ত ঝরে ঢাকার রাজপথে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার মহান আন্দোলনই বাঙালি জাতিকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা তথা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে। মাতৃভাষা আন্দোলনের এবং পর্যায়ক্রমে চলমান প্রতিটি আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সুযোগ্য নেতৃত্ব আমরা দেখতে পাই।

ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবোধ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলভিত্তি একথা বলতেই পারি। বাংলা ভাষার এ আন্দোলন বাঙালির মধ্যে মুক্তির গণচেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। বাংলা ভাষার জন্য এ ধরনের আন্দোলন এবং তাজা তাজা জীবনদানের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত করা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। বিশ্বের আর কোনো দেশের মানুষ এভাবে নিজ ভাষার জন্য সংগ্রাম ও রক্তদানের তথা আত্মবলিদান দিয়েছে এমন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এ কারনেই ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে নতুনভাবে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং তাঁদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ধীরে ধীরে বাংলা ভাষার আন্দোলনই পর্যায়ক্রমে বাঙালি জাতিকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল এ কথা অস্বীকার করার উপায় নাই। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বীজ রোপণ করেছিল, তা পরবর্তী আন্দোলনগুলোর জন্য অনুপ্রেরণা প্রদান করেছে বীর বাঙালিদের এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রেরণা জুগিয়েছে। কাজেই এ কথা বলতে পারি যে, ভাষা আন্দোলনই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সোপান এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির মূলভিত্তি।
——
প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস, আহবায়ক, কবি দেবাশীষ মৃধা সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *