রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। ১০ বছর ধরে চাকরি করেন একটি প্রিন্টিং প্রেসে। মাসিক বেতন ১৭ হাজার টাকা। গতকাল টাউন হল বাজারে তিনি বাজার করতে আসেন। মুদি দোকানি আব্বাস উদ্দিনের কাছে জানতে চান মিনিকেট চালের দাম। কেজি ৭০ টাকা । আর মোটা চালের দাম ৫২ টাকা। আনোয়ার হোসেন খেদের সঙ্গে বলেন, কয়েকদিন আগেই মিনিকেট চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে কিনছি।
এরপর হঠাৎ দেখি দাম বেশি। আর কমার কোনো লক্ষণ নেই। দাম বেশি এজন্য চিকন চাল খাওয়া বাদ দিয়েছি। এখন দেহি মোটা চালের দামও বেশি। খালি চাল না, তেলসহ অন্যসব নিত্যপণ্যের দামও চড়া। এখন আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মিলাতে পারছি না। শুধু আনোয়ার হোসেনই নন। তার মতো এমন স্বল্প আয়ের মানুষেরা আয় আর ব্যয়ের হিসাব মিলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। কেউ বাধ্য হয়ে অতিপ্রয়োজনীয় খরচও কমিয়ে দিচ্ছেন। খাবার তালিকা ছোট হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের মাথাপিছু ব্যয়ের হারও কমাতে হচ্ছে।
নিত্যপণ্যের চড়া দামে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এতে যেমন তাদের আয়ের সঙ্গেও ব্যয়ের ভারসাম্য থাকছে না, তেমনি সংসার চালানোই যেন তাদের পক্ষে দায় হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই করোনার কারণে মানুষের আয়ে ভাটা পড়েছে। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের মুখের হাসি যেন কেড়ে নিয়েছে।
রামপুরার বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন। তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। বেতন ২১ হাজার টাকা। পরিবারে রয়েছে স্ত্রী-সন্তানসহ ৪ জন সদস্য। কিন্তু যা বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালাতে তার হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, একটা সংসার চালাতে যেসব বাজার সদাই দরকার হয় তার সবকিছুর দামই চড়া। কিছুদিন পর পর নতুন নতুন পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কিছুদিন আগে পিয়াজ-আলু নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড শুরু হয়েছিল। এখন চাল ও তেলের বাজারে অস্থিরতা চলছে। একবার যেটা বাড়ে আর কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন হাতিরপুলের আক্কাস মিয়া। তিনি জানান, তাদের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের হাসি-কান্না অনেকটাই নির্ভর করে নিত্যপণ্যের মূল্যের ওপর। মূল্য কম থাকলে তারা পেটপুরে খেতে পারেন। মূল্য লাগামছাড়া হলে অনেক সময় না খেয়েও কাটাতে হয় তাদের। তিনি বলেন, সারাদিন রিকশা চালিয়ে যা কামাই করি তাতে বাজার সদাই করতেই শেষ হইয়া যায়। আমগো কামই হইলো সারাদিন রিকশা চালামু আর রাইতে কিছু বাজার কইরা খামু। আমগো স্বপ্ন বইলা কিছু নাই। তাই সঞ্চয় আর কি করুম। পোলাপানও কামকাজ কইরা খায়। ভবিষ্যৎ নিয়া আমগো ভাবনা নাই। যা দিনে আয় করি তা বাজার সদাই করতেই শেষ হইয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাজারে এখনো প্রায় সব পণ্যের দামই চড়া। নতুন করে চাল ও তেলের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। দাম এখনো বাড়তির দিকে। এর ফলে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষেরা তাদের দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মানবজমিনকে বলেন, করোনাকালে মানুষের আয় কমেছে এটা ঠিক। তবে আমরা আপাতত এর পরিসংখ্যানটি প্রকাশ করিনি। কী পরিমাণ আয় কমেছে এবং ব্যয়ের সঙ্গে সেটার ভারসাম্য কতোটা আছে, সেটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করলে জানতে পারবেন। তবে এটা সত্য যে করোনার কারণে মানুষ চাকরি হারিয়েছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার হয়েছে। মানুষ ব্যবসা হারিয়েছে। এমনকি দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। সেই হিসেবে মানুষের আয় অনেক কমেছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে এসব মানুষ আরো সমস্যার মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে বর্তমানে চাল ও তেলের দাম বেড়েছে। এটা মানুষের জন্য খুবই কষ্টের। যে পরিমাণ তাদের আয় হচ্ছে তার সঙ্গে ব্যয়ের ভারসাম্য থাকছে না। ফলে অনেক মানুষ হতাশার মধ্যে রয়েছে।
এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের দেশের নিম্ন মধ্যবিত্তরা যেসব খাদ্যপণ্য ভোগ করে, সেগুলোর দাম অনেক বেশি। দেশে চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ওপর বড় ধরনের চাপ পড়েছে।