ঢাকা: পুলিশের দেয়া তথ্য বলছে, মেয়েটিকে অতিরিক্ত মদ পান করিয়ে ধর্ষণ করার ফলে তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। এদিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সেলিম রেজা বলেছেন, অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। ধর্ষণের কারণে নয়।
রাজধানীর ধানমণ্ডির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মৃত্যুর বিষয়টি এখনো রহস্যে ঘেরা। শিক্ষার্থীর পরিবার, তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ, চিকিৎসক, নিহতের গ্রেপ্তারকৃত বন্ধুদের পৃথক পৃথক বক্তব্যে রহস্যের জট খুলছে না। নিহতের পারিবারিক সূত্র জানায়, নিহত শিক্ষার্থীর বাবা চট্টগ্রামের একটি ওষুধ কোম্পানিতে ঊর্ধ্বতন পদে দায়িত্বরত আছেন। দুই বোনের মধ্যে সে ছিল বড়। সম্প্রতি ২১ বছর শেষ করে ২২-এ পা রেখেছে। স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষে সফল কর্পোরেট অফিসার হওয়ার। সব স্বপ্নই যেন মিলিয়ে গেল। শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, আমি ভালো নেই।
ওর মা এবং আমি দুজনেই খুব অসুস্থ। কি বলবো! কিইবা বলার আছে আমার। সে বেঁচে নেই। এটাই এখন বড় সত্য। আমি থাকি চট্টগ্রামে। একটি বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। আমি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি ডিপার্টমেন্ট থেকে পাস করেছি। আমার জায়গা থেকে ব্যক্তিগতভাবে ওদেরকে ভালো রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। সব সময় মানসিকভাবে সাপোর্ট দিয়েছি। একজন বাবা হিসেবে যা যা করা দরকার তার সবগুলোই করেছি। মেয়েকে তো সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম।
তিনি বলেন, বড় মেয়ে। আদরের এবং লক্ষ্মী ছিল সে। আমার মেয়ে ছিল অত্যন্ত নম্র-ভদ্র। মেয়ের মদ্যপানের বিষয়ে যা বলা হচ্ছে সেটা আমরা কখনোই জানতাম না। এবং ইতিপূর্বে আমরা দেখিনি। স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে নিয়ে মিরপুর-১ নম্বরের বাসায় থাকি। প্রতি সপ্তাহে আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার বাসায় আসি। কখনোই এসব দেখিনি। আমার দৃষ্টিতে তার মতো ভালো মেয়ে আর দ্বিতীয় ছিল না। বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, রায়হান নামে ছেলেটির সঙ্গে তার কোনো ধরনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল কিনা সেটা আমরা জানতাম না। ঘটনার সময় আমি কর্মস্থল চট্টগ্রামে ছিলাম। পরদিন সকালে আমার ছোট মেয়ে ফোন দিয়ে জানায়, বাবা আপু তো হাসপাতালে এখন। তুমি জানো নাকি? এদিকে আমি তো কিছুই জানি না! মেয়েকে নিয়ে আমাদের অনেক বড় স্বপ্ন ছিল। বড় করতে চেয়েছি। সে আমার মতোই খুব মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল। সে ছিল আমার তৈরি হওয়া গাছ। এখন আমার ফল খাওয়ার কথা ছিল। সব শেষ হয়ে গেল। তিনি বলেন, মেয়ের সঙ্গে সর্বক্ষণই আমার যোগাযোগ ছিল।
মারা যাওয়ার আগের দিন শুক্রবার রাত ১১টায় ওকে আমি ভিডিও কল দেই। মেয়ে আমার ফোনকল রিসিভ করেনি। এর আগে রাত প্রায় ৮টা ৪৯ মিনিটে ওর সঙ্গে শেষবার ফোনে কথা হয়। তখন আমি ওকে বলি, আমার আম্মু কই? ভিডিও কল দাও আমি তোমাকে দেখি। এ সময় জানায় সে বাসায় আছে। কিন্তু আমাকে আর ভিডিও কল দেয়নি। পরবর্তীতে নিত্যদিনের মতো ঘুমানোর আগে রাত ১১টায় তাকে ফোন দিলে সে কথা বলেনি আর। তখন আমি ভেবেছি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন আমিও ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু তখন সে বাসায় ছিল না। হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে- এটা আমি জানতাম না। এখন আমাদের একটিই চাওয়া ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। এবং দোষীদের উপযুক্ত ও সর্বোচ্চ শাস্তি হোক।
এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে রাজধানীর উত্তরার ‘ব্যাম্বু শ্যুটস’ রেস্টুরেন্ট থেকে রাতে মামলার অভিযুক্ত রায়হানের সঙ্গে মোহাম্মদপুরে বন্ধুর ফ্ল্যাটে যান নিহত ওই শিক্ষার্থী। ওই বাসার সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে রাত সাড়ে ১২টার সময় কথিত বয়ফ্রেন্ড মর্তুজা রায়হান চৌধুরীর স্কুটিতে চড়ে মোহাম্মদি হোমস লিমিটেডে তাদের কমন ফ্রেন্ড তাফসিরের বাসায় প্রবেশ করে। এ সময় নিহত শিক্ষার্থীর পরনে একটি ফুলহাতা সোয়েটার-জিন্স এবং কাঁধে একটি লম্বা চেইনযুক্ত ঝোলানো ব্যাগ ছিল। ভেতরে প্রবেশ করার সময় তাকে কিছুটা বিধ্বস্ত দেখা যায়। এ সময় বাসার কেয়ারটেকার গেট খুলে দিলে রায়হান তার স্কুটি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এদিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বাসার কেয়ারটেকার জানান, পরদিন শুক্রবার সকাল ৯টায় রায়হান ওই বাসা থেকে একা বের হয়ে যায়। পরবর্তীতে দুপুর ২টার সময় তাফসিরের সঙ্গে বেরিয়ে যায় নিহত শিক্ষার্থী। এ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় তাদের বাসা থেকে বের হওয়ার ভিডিও ফুটেজটি রেকর্ড হয়নি। তিনি বলেন, এর আগেও নিহত শিক্ষার্থী, রায়হান এবং তার বন্ধুরা প্রায়ই এই বাসায় এসে আড্ডা দিতো।
সূত্র জানায়, নিহত শিক্ষার্থীর বাবা মামলার এজাহারে জোরপূর্বক ধর্ষণের কথা উল্লেখ করলেও তার মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ ও চিকিৎসকের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে। পুলিশের দেয়া তথ্য বলছে, মেয়েটিকে অতিরিক্ত মদ পান করিয়ে ধর্ষণ করার ফলে তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। এদিকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সেলিম রেজা বলেছেন, অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে। ধর্ষণের কারণে নয়। চিকিৎসকের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে রাজি নয় পরিবার এবং পুলিশ। সূত্র জানায়, নিহত শিক্ষার্থীর আরেক বন্ধু আরাফাতও অতিরিক্ত মদ পানের কারণে গত শুক্রবার একটি হাসপাতালে মারা গেছে বলে জানা যায়। অন্য কেউ এ ঘটনায় জড়িত কিনা সে বিষয়ে খতিয়ে দেখছে পুলিশ। মদের সঙ্গে নেশাজাতীয় বা অন্য কিছু মেশানো হয়েছিল কিনা সেটাও তদন্ত করা হচ্ছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক সাজেদুল ইসলাম বলেন, নিহত শিক্ষার্থীর কথিত বয়ফ্রেন্ড মর্তুজা রায়হান চৌধুরী ও নুহাত আলম তাফসিরকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মামলার এজাহারে উল্লিখিত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।