মৃত্যু যদি শূন্য হতো

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


সিরাজুল ইসলাম কাদির: ১৯৯২’র ১৫ই আগস্ট। মতিউর রহমান চৌধুরীর সম্পাদনায় দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করলো। এক ঝাঁক তরুণ সাংবাদিক নিয়ে দৈনিকটির যাত্রা। উদ্যমী, অপার সম্ভাবনাময় এসব তরুণের সারিতে ছিলেন মোস্তফা ফিরোজ দীপু, আমিনুর রশীদ, জুলফিকার আলী মানিক, জাহিদ নওয়াজ জুয়েল, মিজানুর রহমান খান, মিলান ফারাবী, পীর হাবিবুর রহমান, নঈম তারিক, আনিস আলমগীর, প্রভাষ আমিন, মোল্লাহ আমজাদ হোসেন, চৌধুরী জহিরুল ইসলামসহ আরো অনেকে- যাদের নাম এখন স্পষ্ট করে মনে করতে পারছি না। গ্রীণ রোডের ২৪২/এ বাংলাবাজার পত্রিকার অফিস। দ্বিতল ভবনের নিচতলায় ছিল পত্রিকার মূল কার্যালয়। সম্পাদক সাহেব শুরুর একদিন আমাদের সকলকে নিয়ে বসলেন এবং জানতে চাইলেন কে কোন ‘বিট’-এ রিপোর্ট করতে চান। আমি অর্থনৈতিক বিষয়ে প্রতিবেদন করার আগ্রহ ব্যক্ত করার পর কেউ আপত্তি তুললেন না।
মিজানুর রহমান খান চাইলেন কূটনৈতিক বিষয়ে প্রতিবেদন করতে। কিন্তু আমাদের সকলের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বদিউল আলম ইতিপূর্বে এই বিষয়ে প্রতিবেদন করার আগ্রহ ব্যক্ত করায় মিজানের পক্ষে তার যাচিত বিষয়ে প্রতিবেদন করার সুযোগ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। বদিউল ভাই একই সঙ্গে প্রধান প্রতিবেদকের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন।

এভাবেই যাত্রা শুরু হলো দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার। অসংখ্য তরুণ সাংবাদিকদের মধ্যে মিজান আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেন তার অন্তর্নিহিত বেশকিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য। মেধাবী, বিনয়ী, পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা ও সততা এসব গুণ তাকে এক ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে আলোকিত করছিল। মিজান কূটনৈতিক বিষয়ে প্রতিবেদন করার সুযোগ না পেলেও মোটেও নিরুৎসাহিত হননি বা দমে যাননি। তিনি তার উপর ন্যস্ত অন্য বিষয়ে প্রতিবেদন করার প্রতি মনোযোগী হলেন গভীর মমতা আর নিষ্ঠার সঙ্গে। তাকে একবার সরজমিন প্রতিবেদন করার জন্য ঢাকার বাইরে এক জেলা শহরে পাঠানো হলো। তিনি আনন্দের সঙ্গে সেই এসাইনমেন্ট গ্রহণ করলেন। কয়েকদিন পরে ফিরে এলেন পকেটভর্তি প্রতিবেদন করার উপাদান নিয়ে। মিজানের আসনের বিপরীত দিকের টেবিলে আমার আসন নির্ধারিত ছিল। তাকে দেখে উপলব্ধি করলাম তিনি রোদ ভেঙে, শ্রম দিয়ে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদনে কোনো অবহেলা করেননি। শ্যামলা বর্ণের কোমল মুখের প্রলেপের উপর কেউ আলতো করে হালকা কালোর আরেকটা প্রলেপ ছড়িয়ে দিয়েছে। অবিন্যস্ত চুল। ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু মুখজুড়ে তৃপ্তির হাসি। তিনি মনোযোগ দিয়ে রিপোর্ট লিখে যাচ্ছিলেন। তার আসনের পেছনে জানালার গরাদ গলিয়ে দিনের শুভ্র আলো তাকে মহিমান্বিত করে তুলছিল। তার হাসির দ্যুতির সঙ্গে প্রকৃতির আলোর দ্যুতি যেন গলাগলি করছিল। আমি অনির্মেষ তাকিয়ে থাকলাম।

আমরা দুজনেই বৃহত্তর বরিশাল জেলার। কী এক অঘোষিত সখ্য গড়ে উঠলো আমাদের মধ্যে। এক সময় প্রতিবেদন রচনা শেষ হলে তিনি তা সরাসরি মতিউর রহমান চৌধুরীর হাতে দিলেন। সম্পাদকের হাত গলিয়ে ঐ প্রতিবেদন সম্পাদনার জন্য ডেস্কে ন্যস্ত হলো। আমি মিজানকে বললাম, চলুন চা খেয়ে আসি। গ্রীণ রোডের প্রধান সড়কের পাশেই চায়ের দোকান। অনতিদূরে বনফুল মিষ্টির দোকান।

বনফুলের অন্থন (Wonton) আমাদের দুজনেরই পছন্দের খাবার। মিজান আমাকে অন্থনের মূল্য দেয়ার সুযোগ না দিয়ে তিনি পরিশোধ করেন। আমাদের মধ্যে সন্ধি হলো পালাক্রমে আমরা আমাদের নাশতার বিল পরিশোধ করবো। অর্থাৎ একদিন আমি, পরের দিন মিজান। এভাবেই মিজানের সঙ্গে আমার সম্পর্কের একটা ভিন্ন বলয় গড়ে উঠলো। মিজান আমাকে ‘কাদির ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন, আর আমি ‘মিজান’, শুধু মিজান বলে সম্বোধন করতাম। মিজান তার আগ্রহ এবং ভালোবাসা থেকে মাঝে মধ্যে কূটনৈতিক বিষয়ে প্রতিবেদন করতেন- যেগুলো ছিল এক্সক্লুসিভ। আর সেই প্রতিবেদন বাংলাবাজার পত্রিকার এক্সক্লুসিভ বিভাগে ছাপা হতো। আমি নিয়মিত অর্থনৈতিক প্রতিবেদনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক পাতার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করতাম। পাতা মেকআপের দিন মিজান স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে হাত মেলাতেন। পাতার বাহ্যিক সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য তিনি পরামর্শ দিতেন। তার এই সহযোগিতার মনোভাবকে আমি সবসময় শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে মূল্যায়ন করতাম।
বেক্সিমকো গ্রুপ থেকে দৈনিক মুক্তকণ্ঠ প্রকাশিত হলে তিনি ঐ কাগজে কূটনৈতিক সংবাদদাতা হিসেবে যোগ দেন। তবে তার এই কায়িক প্রস্থান কখনোই আমাদের মধ্যেকার নিখাদ সম্পর্কে ছেদ টানতে পারেনি। মুক্তকণ্ঠ থেকে দ্য নিউ নেশন, যুগান্তর, সমকাল এবং সবশেষে প্রথম আলোতে এসে তিনি থিত হন। এভাবে আমিও জীবনের নানা বাঁক পেরিয়ে রয়টার্সে এসে থিত হই। রয়টার্সে প্রতিবেদন করার সময় আমি মাঝে মধ্যেই তাকে ফোন করতাম। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে মিজানের কণ্ঠস্বর শ্রুত হলেই প্রশান্তির পরশ আমাকে মুগ্ধ করতো। বিনয়ী কণ্ঠ। আমি কল্পনার চোখে তার মৃদু হাসিময় মুখাবয়ব দেখতাম। আইনি জটিলতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে তার সঙ্গে প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু নিয়ে আলাপ করতাম। তিনি তার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পরামর্শ আমাকে দিতেন বিশ্বস্ততার সঙ্গে। তবে প্রায়ই তিনি ড. শাহদীন মালিক, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম কিংবা ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য অনুরোধ জানাতেন। পেশাগত ব্যস্ততায় নিবিষ্ট থাকলেও তিনি আমাকে সবসময়ই তার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জায়গা থেকে অপসারণ করেননি। তার তথ্যসমৃদ্ধ নিবন্ধ আমাকে মুগ্ধ করতো। পাঠক মাত্রই অনুধাবন করতে সক্ষম হতেন যে, এই নিবন্ধ রচনার জন্য তিনি এ বিষয়ে গভীর পাঠ ও চর্চা করেছেন। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকে ফোন করে আমার ভালো লাগার অনুভূতি ব্যক্ত করতাম। ২০০৪ সালে আমরা প্রায় ২ সপ্তাহের জন্য ভারত সরকারের আমন্ত্রণে দেশটি সফরের সুযোগ পাই। তখন তাকে আরো কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটে।

মিজানের কৃতজ্ঞতা বোধ তাকে মহীয়ান করে রেখেছে। মতিউর রহমান চৌধুরীর স্নেহের শেকল গড়িয়ে তাই তিনি কখনোই তার কাছ থেকে দূরে সরে যাননি। সেজন্য আমি জনাব চৌধুরীর বাসভবনে ঈদের মিলনমেলা কিংবা দৈনিক মানবজমিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কেক কাটার আনন্দঘন অনুষ্ঠানে মিজানকে অনুপস্থিত থাকতে দেখিনি। স্নেহ-ভালোবাসা যে কতো অমূল্য সম্পদ তা তিনি নিজে উপলব্ধি করতেন। তাই আমি কখনো কোনো অনুযোগ করলে তিনি বলতেন, “কাদির ভাই পুরনো বন্ধুদের হারিয়ে নতুন বন্ধুর প্রত্যাশা আমার নীতিবিরুদ্ধ চর্চা।”

মিজানের কনিষ্ঠ ভাই মসিউর রহমান খানের কাছে মিজানের অসুস্থতার খবর শোনার পর কায়োমনো বাক্যে তার আরোগ্য কামনা করতাম। সর্বশেষ ১১ই জানুয়ারি স্নেহভাজন শওকত হোসেন মাসুমকে ফোন করলাম মিজানের সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য। চিকিৎসককে উদ্ধৃত করে মাসুম বললেন, “কাদির ভাই অলৌকিক ঘটনা ছাড়া তার ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।” মাসুমের ফোন রেখে কী এক দুর্বার টানে আমি মিজানের সেলফোনে ফোন করলাম। ও প্রান্তে নীরবতার শীতলতা আমার অনুভূতির দরজায় করাঘাত করলো। কিশোর বয়সে আমার পিতা ছিলেন আমার কল্পনার জগতে শক্তির মহাকাব্য। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মৃত্যু তাকে কখনোই আঘাত করার সাহস পাবে না। আমার কিশোর বয়সের সেই দৃঢ় বিশ্বাসকে নশ্বর প্রতীয়মান করে একদিন তিনি ওপারে চলে গেলেন। আমি তখন তার শিয়রে বসা, মূক, বেদনাক্লিষ্ট। চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করার পর আমি গভীর বিশ্বাসে আব্বা বলে ডাক দিলাম। তিনি তার পরম স্নেহের পুত্রের ডাকে এই প্রথমবার নিরুত্তর রইলেন। যেমন ১১ই জানুয়ারি মিজানের ফোন থেকে নিঃশব্দের শীতল বরফ আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ তার “মৃত্যু” কবিতায় এভাবে মৃত্যুকে দেখেছেন:
মরণের ছবি মনে আনি।
ভেবে দেখি শেষ দিন ঠেকেছে শেষের শীর্ষক্ষণে।
…একি সত্য হতে পারে।
উদ্ধত এ নাস্তিত্ব যে পাবে স্থান
কি অণুমাত্র ছিদ্র আছে কোনখানে।
সে ছিদ্র কি এতদিনে
ডুবাতো না নিখিল তরণী
মৃত্যু যদি শূন্য হতো,
যদি হতো মহাসমগ্রের
রূঢ় প্রতিবাদ।

[লেখক রয়টার্সের সাবেক ব্যুরো প্রধান এবং বর্তমানে তিনি আমেরিকান চেম্বার্স জার্নালের নির্বাহী সম্পাদক]
ঊ-সধরষ : [email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *