ওরা কেন বিপথগামী?

Slider বিচিত্র

মাদকের নেশা, ইন্টারনেটে আশক্তি, পর্নো মুভি কিশোরদের বিপথে টেনে নিচ্ছে। প্রায় ঘরে ঘরেই এখন এমন আসক্তি ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে কিশোররা সমাজে নিজেদের প্রভাব দেখাতে হয়ে উঠছে বেপরোয়া। গড়ে তুলছে কিশোর গ্যাং। তৈরি হচ্ছে তাদের প্রতিপক্ষ। এভাবে একে-অপরকে শায়েস্তা করতে হয়ে উঠছে প্রতিশোধ পরায়ণ। এতে করে ঘটছে অঘটন। রাজধানীর পাড়ায় পাড়ায় এখন কিশোর গ্যাংয়ের দাপট চোখে পড়ে।

শুধু রাজধানীই নয়, গোটা দেশেই এখন চলছে কিশোং গ্যাং আতঙ্ক। কারণ ওরা কাউকে মানে না। নেই শ্রদ্ধাবোধ। রাস্তা ঘাটে বেপরোয়া চলাফেরায় অন্যরা বিরক্ত হলেও তাদের কিছুই যায় আসে না। এমন ভাব নিয়ে তারা প্রকাশ্যে চলাফেরা করছে। তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে নিত্য-নতুন অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে তারা। জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। হত্যা, ধর্ষণের মতো অপরাধে উঠছে কিশোরদের নাম। মাদকের ভয়াল জগতেও অবাধ বিচরণ তাদের। ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহারও তৈরি করেছে সংকট। রপ্ত করছে অপরাধের হরেক রকম কৌশল। সমাজে নৈতিকতার স্খলন হচ্ছে চরমভাবে। মানবিক গুণগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বহুলাংশে। অভাব রয়েছে ধর্মীয় মূল্যবোধেরও। প্রশ্ন উঠেছে, কেন বিপথগামী তরুণ প্রজন্মের একাংশ। এসব বিষয়ে সমাজ বিশেষজ্ঞরা জানান, পুরো দুনিয়া হাতের মুঠোয়। প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত সব বয়সীদের হাতে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট। প্রযুক্তির এই আশীর্বাদটি ব্যবহার হচ্ছে নানাভাবে। অভিভাবকদের অজান্তেই তাদের সন্তান আসক্ত হচ্ছে পর্নোগ্রাফিতে। ভয়ঙ্কর, বিপদ সংকুল পথে পা বাড়াচ্ছে প্রজন্ম। ঘটছে সামাজিক, মানবিক অবক্ষয়।

অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা ভবিষ্যতের হাল ধরবে যাদের হাতে থাকার কথা ছিল কলম-খাতা। কিন্তু হালে তাদের হাতে এখন মাদক ও অস্ত্রের মতো ভয়ঙ্কর জিনিস। জীবনের শুরুতেই যারা মানুষ খুন ও বিকৃত যৌনাচারের মতো ঘটনায় জড়িত হচ্ছে তারা ভবিষ্যতে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। তাই অভিভাবক থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী, শিক্ষক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রত্যকের নিজ নিজ জায়গা থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে। শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠার জন্য সঠিক পরিবেশ, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, কাউন্সিলিং ও সুপারভাইস করতে হবে। তাদের গন্তব্য ও করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। দেশের কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের জন্য নেয়া হয় সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর দ্বারা পরিচালিত কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে। তাদের তথ্য মতে সংশোধনের জন্য যেসব কিশোরকে তাদের কাছে পাঠানো হচ্ছে তাদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সের কিশোররাই বেশি অপরাধে জড়াচ্ছে। কিশোররা, চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে বলে কেন্দ্রের তথ্যে জানা যায়। এদিকে সূত্রমতে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ৪০টির মতো কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি গ্যাং-এর সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য দ্বারা গত এক বছরে ঢাকায় অন্তত পাঁচটি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

সম্প্রতি রাজধানীর কলাবাগানে ইংলিশ মিডিয়ামের এক ছাত্রীর ‘হত্যা ও ধর্ষণ’র অভিযোগে মামলা হয়েছে। ওই ছাত্রীর লাশের ময়নতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ময়নাতদন্তকালে আমরা দেখতে পাই তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। আর সেটি হয়েছে মূলত তার ‘ভ্যাজাইনাল’ এবং রেক্টাম’ রক্তক্ষরণ। ঘটনাটিকে তিনি বিকৃত যৌনাচার হিসেবে মন্তব্য করে বলেছেন তার ২৫ বছরের চিকিৎসা ক্যারিয়ারে এমন ঘটনা আর পাননি। ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের কয়লাঘাট এলাকায় পায়ে পাড়া দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিফাত নামের ১২ বছর বয়সী এক শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল। এ ঘটনায় ৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। তাদের প্রত্যেকের বয়স ছিল ১৪ বছরের মধ্যে। গত বছরের নভেম্বরে ঢাকার একটি হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য নেয়া নারীদের লাশের সঙ্গে যৌন লালসা চরিতার্থ করার অভিযোগে এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার যুবক হাসপাতালের মর্গের ডোমের সহকারী হিসেবে কাজ করতো। সর্বশেষ গত ১লা জানুয়ারি রাজধানীর মহাখালীতে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ছুরিকাঘাতে আরিফ হোসেন (১৭) নিহত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, সময়ের প্রেক্ষাপটে দেশে বিকৃত যৌনাচার বেড়ে যাচ্ছে। এটি সামাজিক একটি সংকট। সমাজের মানবিক দিকগুলো কাজ করছে না। সামাজিক অনুশাসনের অভাব। পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ ও জেন্ডার সহনশীলতার ঘাটতি রয়েছে। আত্মকেন্দ্রিক প্রবণতা বাড়ছে। অভিভাবকরা সন্তানকে প্রযুক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। সেখানে অপ্রত্যাশিত কনটেন্টগুলো চাইলেই দেখতে পাচ্ছে। তিনি বলেন, তরুণদের মধ্যে পর্নোগ্রাফি রিলেটেড আকর্ষণ রয়েছে। যৌন শিক্ষার অভাবে এটা দেখার পর বিকৃত মানসিকতার সৃষ্টি হতে পারে। যৌনকর্মের যদি বৈধ প্রক্রিয়া না থাকে তখনই ঘটে বিপত্তি। বিকৃত যৌনকর্মে আসক্ত ওই ব্যক্তির দ্বারা তখন নারী, শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। সমাজে যখন আইনের শাসন দীর্ঘসূত্রিতায় বন্দি হয়ে যায় বা বিচার প্রার্থীরা বঞ্চিত হয়, সমাজিক অনুশাসন থাকে না। তখন বিকৃত মানুষদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। সামাজিক দুর্যোগ দেখা দেয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে সামাজিক-মানবিক উন্নয়ন ঘটাতে হবে। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে বলে জানান তিনি।

প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার, সামাজিক নানা কারণে সমাজে বিকৃত যৌনাচারের ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করেছেন মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আফরোজা হোসেন। তিনি বলেন, জৈবিক চাহিদা খাবারের ক্ষুধা অনুভব হওয়ার মতোই। মানবিক গুণাবলী, যথাযথ শিক্ষা না থাকলে এই ক্ষুধা নিবারণে অনেকেই পশুত্বের পর্যায়ে চলে যায়। এই ক্ষুধা উস্কে দেয়ার জন্য বৈশ্বিক নানা ব্যবস্থাপনা রয়েছে। প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারে চাইলের যা ইচ্ছে দেখা যাচ্ছে, মস্তিষ্কে ঢুকানো যাচ্ছে। তাই এই ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা জরুরি। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এই শিক্ষা দিতে হবে। সেইসঙ্গে ধর্ষকদের শাস্তি পাওয়াটা জরুরি। কারণ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এটাকে তেমন কোনো অপরাধ মনে করে না অনেকে। একজন ধর্ষককে দেখে আরও অনেকে উৎসাহিত হয় বলে মনে করেন তিনি।

সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশে যে ধরনের সমস্যা বা অপরাধ আছে সেটি পৃথিবীব্যাপী আছে। তবে দেশভেদে সমাজভেদে তার ধরন ও মাত্রা আলাদা। তেমনি প্রত্যেক বয়সের একটা ধর্ম আছে। কিশোর-তরুণরা যা কিছু করছে এটাও বয়সের তাদের ধর্ম। যারা বিকৃত রুচির তাদের বেড়ে উঠাটা সুন্দর হয়নি। যার যার বেড়ে উঠার ওপর তার আচার-আচরণ প্রতিফলিত হবে। যারা বিপথগামী হচ্ছে খোঁজ নিলে দেখা যাবে ওইসব শিশু কিশোরদের ঠিকমতো সুপারভাইস করার মানুষ নেই। হয় তাদের বাবা-মা দু’জনই চাকরি করে, না হয় তাদের সঙ্গে সন্তাদের সম্পর্ক বা যোগাযোগ নেই। এছাড়া এমনও হয় বাবা চাকরি বা ব্যবসা করে আর মা ঘর সামলাতে ব্যস্ত। এই সুযোগে সন্তানরা নিজেদের মতো করে চলছে। সন্তান জন্ম দিলেই হয় না। দেখভাল করতে হয় সে কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কার সঙ্গে মিশছে। সময়মতো বাড়ি ফিরছে কিনা, তার পকেট খরচ বেড়ে যাচ্ছে কিনা, দেরি করে ঘুম থেকে উঠে কিনা। যদি মাঝে-মধ্যে ঘুম থেকে দেরি করে উঠে তবে সমস্যা নাই। যদি প্রতিদিনই দেরি করে উঠে তবে বুঝতে হবে রাত জেগে কি করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *