নেপাল উত্তাল, সংসদ বিলুপ্ত মন্ত্রীদের পদত্যাগ, রাজতন্ত্রপন্থিরা রাস্তায়

Slider সারাবিশ্ব

দীর্ঘদিনের বন্ধু বলে পরিচিত দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও নেপাল। আয়তন এবং জনসংখ্যার ফারাকটা বিশাল হলেও দুটোই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। সংস্কৃতি এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই বেশ মিল। কিন্তু গেল বছর বলা চলে হঠাৎ করেই তীব্র কূটনৈতিক বিবাদ শুরু হয় দু’দেশের মধ্যে। ভারতের উত্তরাখণ্ড, চীনের তিব্বত আর নেপালের সীমানা যেখানে মিশেছে সেখানে হিমালয়ের লিপুলেখ নামক গিরিপথে কালাপানি নামে একটি এলাকা রয়েছে- যেটি ভারতের নিয়ন্ত্রণে হলেও নেপাল তার অংশ বলে দাবি করে। ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রশাসনিক পুনর্গঠনের পর ভারত যে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে, তাতে কালাপানিকে ভারতের মধ্যে দেখানোর প্রতিবাদ জানিয়েছিল নেপাল। ২০২০ সালের মে মাসে লিপুলেখের সঙ্গে সংযোগকারী একটি লম্বা পার্বত্য রাস্তার উদ্বোধন করেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। ব্যস।
এর বিরুদ্ধে ঝড় বয়ে যায় নেপালের পার্লামেন্টে। একজন এমপি তো বলেই বসেন, ভারতের ‘দাদাগিরি’র বিরুদ্ধে অধিকাংশ নেপালি গর্জে উঠবে। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তীব্র নিন্দা জানায়। ওই অঞ্চলের কাছে পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করে এবং কাঠমান্ডুতে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে।

ভারতের চিফ অব আর্মি স্টাফ মনোজ নারাভানে তখন মন্তব্য করেন, ওই লিংক রোডের ব্যাপারে নেপাল সরকারের আপত্তি এসেছে ‘অন্য কারো নির্দেশে’। তিনি যে চীনকেই ইঙ্গিত করেছেন তা আর বলতে হয় না। অনেকে আবার মনে করেন এসব আসলে ভারতবিরোধিতা নয়, নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতিফলন। প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি ভারতবিরোধী প্রচারণাকে পুঁজি করেই ক্ষমতায় এসেছেন। তাছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিতেও প্রচন্ড’র সঙ্গে তার তীব্র ক্ষমতার লড়াই চলছে। তিনি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পথ বেছে নিচ্ছেন। তাই স্বভাবতই তিনি উচ্চস্বরে কথা বলছেন।

কিন্তু ক’দিন বাদেই কালাপানি, লিপুলেখকে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় নেপালি সরকার। সংকট ঘনীভূত হয়। নতুন মানচিত্র নিয়ে ভোটাভুটিতে নেপালের কোনো এমপিই বিপক্ষে ভোট দেননি। এমনকি ভারতপন্থি বলে পরিচিত এমপিরাও! অনেকে বলেন, রাজনাথ সিং যখন ওই রাস্তা উদ্বোধন করেন তখন হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি যে, এটা নিয়ে নেপালের সঙ্গে এত বড় সংকট তৈরি হবে। ক্ষুদ্র প্রতিবেশী নেপালের প্রতিক্রিয়ায় শুধু রাজনাথই নন, ভারতের সর্বমহলে বিস্ময় এবং উদ্বেগ তৈরি হয়।
কিন্তু নেপালের বক্তব্য- হুট করে তারা এমন সিদ্ধান্ত নেয়নি। সেই নব্বই’র দশক থেকেই ভারতের কাছে তারা বিরোধপূর্ণ এলাকা নিয়ে কথা বলতে চাইছে। ২০১৪ সালে নেপালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকালেও এটা তারা আলোচনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারত প্রতিবারই তা পাশ কাটিয়ে গেছে।

যাই হোক, ওই সময় নেপালি সংসদের বাইরেও সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধিতার চিত্র ছিল স্পষ্ট। নেপালের সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভারত পিছু হটো’ আলোড়ন তুলে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেক বিশ্লেষক বলেন, সামপ্রতিক বছরগুলোয় ভারত জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের আমদানির ওপর নেপাল সীমান্তে বাধা তৈরি করে। যে কারণে নেপালিদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হয়। তারা মনে করছে, চীনের সমর্থনে তাদের এখন ভারত বিরোধিতার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে।

কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ভারত তখন উদ্ভূত সংকট সমাধানে খুব বেশি তৎপর হয়নি। কিন্তু জুলাই মাসে নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মন্ত্রীদের সঙ্গে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভার্চ্যুয়াল বৈঠকের পর ভারতের মিডিয়ার সঙ্গে আড়মোড়া ভেঙে নড়েচড়ে বসে সাউথ ব্লকও। ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একই সুরে বলতে থাকেন, চীন দক্ষিণ এশিয়াতে যা-ই করে তার লক্ষ্য থাকে ভারত। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যেভাবে তারা সম্পর্ক গড়তে চলেছে তারও উদ্দেশ্য ভারতকে এই অঞ্চলে ক্রমশ কোণঠাসা করে দেয়া।

এরপর আগস্টে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ কুমার গাওয়ালি এক আলোচনায় বলেন, নেপাল থেকে গোর্খা সৈন্য নিয়োগ নিয়ে ১৯৪৭-এ বৃটেন ও ভারতের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটি ‘অপ্রয়োজনীয়’ হয়ে পড়েছে। চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার সময়টাতে তাদের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধে নেপালিদের ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে ভারতের পক্ষে অংশ নেয়া নৈতিকভাবে উচিত কিনা, বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে সাধারণ নেপালিদের এমন প্রশ্নের জবাবেই তিনি একথা বলেন বলে মনে করা হয়।

এরপর করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে যখন গোটা বিশ্বই ব্যস্ত তখন অনেকটা যেন চুপচাপ ছিল সবকিছু। হঠাৎ করেই ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো চীন ও নেপাল মতৈক্য করে যৌথভাবে ঘোষণা করে যে, পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের উচ্চতা বেড়েছে। তখন পর্যন্ত সবই চলছিল ঠিকঠাক। নেপাল চীনপন্থি হয়ে গেছে- এমন কথাও ছড়াচ্ছিল বাতাসে।

কিন্তু বছরের একেবারে শেষে প্রধানমন্ত্রী অলির অনুরোধে সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারি। আগামী ৩০শে এপ্রিল ও ১০ই মে নতুন নির্বাচনের তারিখও প্রস্তাব করেন প্রেসিডেন্ট।

কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (মাওবাদী) দলের নেতা পুষ্প কমল দহল প্রচন্ডের সমর্থন নিয়ে ২০১৮ সালে জোটবদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন কেপি শর্মা অলি। কিন্তু জোট এমনকি নিজ দল এনসিপিকে না জানিয়ে বিভিন্ন নীতিগত সিদ্ধান্ত ও গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ দিচ্ছেন, এই অভিযোগে অলিকে পদত্যাগের আহ্বান জানান নেতারা। অলির বিরুদ্ধে সংসদে নো-কনফিডেন্স ভোট আনার উদ্যোগ শুরু হলে খবর পেয়ে তিনি সংসদ ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন বলেও গুজব রয়েছে। তবে অলি বলেন, দেশকে ‘অকার্যকর অবস্থা’ থেকে বের করে আনতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাতে রক্ষা হয়নি। অলির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সাতজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। অলির সংসদ ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আদালতে কয়েকটি পিটিশনও দায়ের করা হয়। অলিকে ক্ষমতাসীন জোট এনসিপি’র কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এমন এক উত্তেজনাকর সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ কুমার গাওয়ালি এ মাসেই নয়াদিল্লি সফরে যাবেন বলে নিজেই নিশ্চিত করেছেন। নেপাল-ভারত যৌথ কমিশনের ষষ্ঠ বৈঠকে নেপাল প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন বলা হলেও ভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে ‘অন্যান্য বিষয়ে’ বৈঠকই মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

এদিকে চলতি রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেই চাপ বাড়াচ্ছে রাজতন্ত্রপন্থিরা, রাস্তায় নেমেছে তারা। নেপালে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের মর্যাদা পুনর্বহালের দাবিতে শুক্রবার কাঠমান্ডুতে মিছিল হয়েছে। ২০১৫-তে গৃহীত সংবিধানে নেপালকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হলেও রাজতন্ত্রপন্থিরা তা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবি নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করা হোক, যেখানে নিরপেক্ষ শক্তি হিসেবে থাকবে রাজতন্ত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *