ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে জটিলতা, শিক্ষক কর্মচারীর বেতন ৭ মাস থেকে বন্ধ

বাংলার মুখোমুখি

হাসানুজ্জামান হাসান,লালমনিরহাট প্রতিনিধি:লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠন নিয়ে জটিলতায় শিক্ষক কর্মচারীদের বেতনভাতা ৭ মাস থেকে বন্ধ রয়েছে। ফলে অর্থাভাবে অধিকাংশ শিক্ষক কর্মচারী মানবেতর জীবনযাপন করছে। অপরদিকে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতনভাতাদি প্রদানের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে শিক্ষা মন্ত্রনালয় ও মহামান্য হাইকোর্ট নির্দেশনা দিলেও অদৃশ্য কারণে তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।

হাতীবান্ধা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারীদের আবেদন সুত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ২৫ এপ্রিলে ঐ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। পরবর্তী ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচন গঠন চলাকালে এর উপর অনিয়মের অভিযোগ এনে জনৈক অবিভাবক মোঃ দুলাল হোসেন মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন নং ৪৫৩২/২০২০ দায়ের করলে শুনানি অন্তে মহামান্য হাইকোর্টের রূলনিশি জারি করেন। ফলে পুর্নাঙ্গ ম্যানেজিং কমিটি/এডহক কমিটি গঠন নিয়ে শুরু হয় জটিলতা। ফলে জুন মাস থেকে চলতি ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ঐ স্কুলের সকল শিক্ষক কর্মচারীর বেতন-ভাতা উত্তোলন করতে পারেনি।

বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রাদুর্ভাবে ঐ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারীগণ বেতন-ভাতা উত্তোলন করতে না পেরে নানাভাবে লাঞ্চিত ও বঞ্চনার স্বীকার হয়েছে। বর্তমানে দ্রব্য মুল্য উর্দ্ধমুখির বাজারে পরিবার পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ফলে এতে শিক্ষক-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নাগরিক হিসেবে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা চিকিৎসার মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে। ৭ মাস যাবত বেতন-ভাতা উত্তোলন করতে না পেরে অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারীর মর্যাদাহানীসহ আর্থিক দৈন্যতা চরমে পৌঁছে গেছে। ধারদেনা করাসহ দাদন ব্যবসায়ীর কাছে ব্যাংকের চেকবই বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। ঋণের পাল্লা দিনদিন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।

অপর দিকে ঋণের টাকা সময়মত পরিশোধ করতে না পেরে অনেক দাদন ব্যবসায়ী শিক্ষক কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিচ্ছে বলে জানা গেছে। এ থেকে রেহাই পেতে ঐ স্কুলের শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর বারবার আবেদন করেও তার কোন সুফল পাচ্ছেনা বলে শিক্ষক কর্মচারীদের দাবী। আর এ সমাধান কবে হবে তা কেউ বলতে পারছেনা।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড দিনাজপুর এর স্মারক নং- মাউশিবোদি/বিদ্যা অনুঃ২০২০/১৯৪৬(০৫) তারিখ- ০৫/০৫/২০২০ খ্রিঃ- এর আলোকে কমিটিবিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে শিক্ষক কর্মচারীদের বিলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে প্রতিস্বাক্ষর দিয়ে বিল প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে।

একইভাবে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের স্মারক নং-শিম/শাঃ১১/২(২)/৯৯(অংশ-১)/১২৮৮ তাং- ০৫/১০/২০২০ খ্রিঃ-এর আলোকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহে (স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা) ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিং বডি কোন কারণে স্থগিত থাকলে বা সভাপতি না থাকলে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বিলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রতিস্বাক্ষর দিয়ে বিল প্রদান করার নির্দেশনা এবং মহামান্য হাইকোর্টের রিট পিটিশন নং-৫৪৫২/২০২০ এর শুনানির নির্দেশনার আলোকে হাতীবান্ধা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারী গণ বারবার আবেদন করলেও তা আমলে নেয়নি উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামিউল আমিন। যার স্বারক নং- হাআউবিঃ/২০২০-৯৩-২(১) ও হাআউবিঃ/২০২০-৯৪-২(১)। তারিখ- ০৮/১১/২০২০ ও ০৯/১২/২০২০। যার সকল অনুলিপি প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।

সর্বশেষ নিরুপমা হয়ে হাতীবান্ধা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শহিদুল ইসলাম ঐ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির জটিলতায় জুন মাস থেকে স্কুলের বন্ধ থাকা বেতন-ভাত প্রদানের অনুমতি জন্য মহামান্য হাইকোর্টের রিট পিটিশন নং- ৫৪৫২/২০২০ শুনানির জন্য আবেদন করেন। শুনানি অন্তে মহামান্য হাইকোর্ট শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক নতুন কমিটির অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক ও কর্মচারীর বেতন-ভাত উত্তোলনের স্বার্থে প্রতিষ্ঠানে বিলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামিউল আমিনকে প্রতিস্বাক্ষর দিয়ে বিল প্রদানের নির্দেশ দিলেও আজও কোন শিক্ষক কর্মচারী বেতন-ভাতা পাননি।

ঐ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশনকারী জনৈক অভিভাবক মোঃ দুলাল হোসেনের সাথে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনের সময় যথেষ্ট অনিয়ম করা হয়েছে। ফলে আমি হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে আদালত রুল জারি করেন। সেই রুলের এখনও চুড়ান্ত রায় হয়নি বলে তিনি আরও বলেন।

হাতীবান্ধা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল মতিনের সাথে কথা হলে তিনি ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলেন, আমার স্ত্রী দেড় বছর যাবত ব্রেইন স্ট্রোকে বিছানায় পড়ে আছে। তার চিকিৎসা করতে অনেক টাকা ঋণ হয়েছে।

স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ যোগাতে না পেরে আমার শেষ সম্বল বেতনের চেক বই ও ১৫ শতাংশ জমি বন্ধক এবং দেড় শতাং বিক্রি করে তার চিকিৎসা করি। তার উপর গত জানুয়ারি মাসে স্কুলের জাতীয় খেলাধুলা চলাকালে আমার পা ভেঙ্গে যায়। সংসার চালানো তো দুরের কথা স্ত্রীসহ নিজের চিকিৎসা করার মতো সামান্য অর্থও নেই। ৭ মাস থেকে স্কুলের বেতন-ভতা বন্ধ থাকায় প্রায়ই না খেয়ে অর্ধাহারে থাকতে হয়। বাকি খেতে খেতে এখন দোকানদারও আর বাকি দিতে চায়না। ফলে ভালো ভাবে চলাফেরা করতে পারছিনা। এভাবে আর কিছুদিন চললে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবেনা বলে তিনি কাদতে থাকেন।

অপর এক সহকারী শিক্ষক (কাব্য তীর্থ) রতন কুমার সেনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমার জমানো টাকা বা সম্পদ বলতে কিছুই নাই। জুন মাস থেকে বেতন বন্ধ থাকায় খুবই কষ্টের মাঝে আছি। সংসার চালাতে ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নিতে হয়েছে। এখন সেই টাকা সময়মত পরিশোধ করতে না পারায় তারা আমার নামে মামলা করার হুমকি দিচ্ছে।

এবিষয়ে কথা হলে হাতীবান্ধা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এমজি মোস্তফা বলেন, দ্রব্যমূল্য উর্দ্ধমূখির বাজার ও করোনাকালীন সময়ে যেখানে একজন সাধারণ শিক্ষা কর্মচারীর সংসার চালাতে দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। সেখানে শিক্ষা বোর্ড, সচিবালয় ও মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা দেয়ার পরও গত জুন মাস থেকে স্কুলের শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ রেখে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মানিবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। যে কোন গণতান্ত্রিক দেশের জনসাধারণের জন্য এটা মঙ্গলজনক নয়। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির জটিলতার জন্য স্কুলের শিক্ষক কর্মচারীগণ যেহেতু অপরাধী নয়, তাই অনতিবিলম্বে তাদের বেতন-ভাতার বিলে প্রতিস্বাক্ষর দিয়ে তা সমাধানের অনুরোধ করেন ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক।

হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামিউল আমিন বলেন, ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ আবেদন করলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে প্রিজাইটিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়। পরে প্রিজাইটিং অফিসার নির্বাচন সম্পন্ন করেন। এরপর সেই কমিটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনৈক একজন অভিভাবক হাইকোর্টে রিট করে, অপর দিকে দায়িত্ব বুঝিয়ে পাওয়ার জন্য ঐ কমিটির সভাপতিও হাইকোর্টে রিট করেন। ফলে দুই পক্ষের রিটের চুড়ান্ত রায় না দেয়া পর্যন্ত ঐ স্কুলের শিক্ষক কর্মচারীগন বেতন ভাতা পাচ্ছেনা।

শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রনালয় ও মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও এখন তারা বেতন-ভাতা পাচ্ছেনা এমন একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, এখানে একটি পক্ষ বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য একটি পক্ষ মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন করে নির্দেশনা আনছে আর একটি পক্ষ ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন নিয়ে জটিলতার চুড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত ঐ স্কুলের শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ রাখার জন্য রিট পিটিশন করে নির্দেশনা আনছে। ফলে উভয় পক্ষের রিটের চুড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত তারা বেতন-ভাতা পাচ্ছেনা। তবে ঐ স্কুলে ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে জটিলতার কারণে চুড়ান্তভাবে এখন কোন কমিটি অনুমোদন পাননি বলে তিনি জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *