সিলেট: এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনার ৩৮ দিন পর আদালতে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। এতে গ্রেপ্তার হওয়া ৮ ছাত্রলীগ কর্মীকে ঘটনার জন্য দায়ী করেছে পুলিশ। গণধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল ৬ জন। এরা হচ্ছে- ছাত্রলীগকর্মী সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন আইনুল ও মিসবাউল ইসলাম রাজন। আর ধর্ষণে সহযোগিতা করেছে রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাছুম।
গতকাল সকালে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরান থানার ওসি (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম আবুল কাশেমের আদালতে চার্জশিট জমা দেন। পুলিশ গণধর্ষণের ঘটনার সময় অন্যান্য অপরাধের জন্য পৃথক চার্জশিট ও অস্ত্র আইনে দায়ের করা মামলায় আরো একটি চার্জশিট দাখিল করেছে। ফলে আলোচিত এ ঘটনায় পৃথক পৃথক ধারায় তিনটি চার্জশিট দাখিল করা হলো।
চার্জশিটে সাক্ষীর তালিকায় রাখা হয়েছে ৪৯ জনকে। এর মধ্যে রয়েছে ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা ছাত্রসহ অন্যরা। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) মো. আশরাফউল্লাহ তাহের মানবজমিনকে জানিয়েছেন- গতকাল সকালে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। এ সময় তার সঙ্গে আদালত পুলিশের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান- ডিএনএর ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য পুলিশ অপেক্ষায় ছিল। তিনদিন আগে ওই রিপোর্টটি হাতে পাওয়ার পর চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এদিকে- আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হলেও শুনানি হয়নি। পরবর্তী তারিখে শুনানির জন্য চার্জশিট রেখে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। গত ২৫শে সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেধে প্রাইভেট কারের ভেতরেই খোলা মাঠে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেছিল ছাত্রলীগ কর্মীরা। এমসি কলেজ ছাত্রলীগের অপরাধ কর্মকাণ্ডের মূল হোতা দুর্ধর্ষ অপরাধী সাইফুর, শাহ রনি, তারেক, অর্জুন সহ ৬ জন মিলে ওই গৃহবধূকে গণধর্ষণ করে। ধর্ষণের সময় ওই গৃহবধূ চিৎকার করলেও ছাত্রলীগ কর্মীদের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেননি। গণধর্ষণের ঘটনার পর তারা গৃহবধূর স্বামীর প্রাইভেট কার রেখে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। এছাড়া ধর্ষণের সময় তারা গৃহবধূর গলার চেইন, কানের দুল ও টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সিলেটজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভ। এমসি কলেজের ইতিহাসে আগে কখনো এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেনি। তবে- এই ধর্ষণের ঘটনার পর জানা যায়- এমসি কলেজে বেড়াতে যাওয়া মানুষদের কাছ থেকে সর্বস্ব ছিনতাই, শ্লীলতাহানী সহ নানা ঘটনায় জড়িত ছিল ছাত্রলীগ কর্মীরা। ঘটনার পর পুলিশ ও র্যাব সিলেটের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। আসামিরা আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে। তবে- তারা ধর্ষণের ঘটনার একে অপরের কাধে দায় চাপিয়ে দিয়েছিল। ফলে পুলিশ সব আসামির ডিএনএ টেস্ট করায়। তিনদিন আগে ওই ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট এসে পুলিশের হাতে পৌঁছে। এতে ৬ আসামির ডিএনও টেস্ট মিলে যায়। এর আগে পুলিশের তদন্তেও একই বিষয় উঠেছিল। এদিকে- গতকাল সিলেটের আদালতে চার্জশিট দাখিলের পর দুপুরে নিজ কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) সোহেল রেজা। প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি জানান- ধর্ষণের ঘটনায় সরাসরি জড়িত এজাহারভুক্ত আসামি সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর। আর এজাহারের বাইরে আইনুদ্দিন আইনুল ও মিসবাউল ইসলাম রাজনও ধর্ষণে জড়িত রয়েছে। এছাড়া- রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুমের বিরুদ্ধে ধর্ষণে সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি জানান- ডিএনএ রিপোর্টে আসামি আইনুল ও রাজনের সিঙ্গেল রিপোর্ট ও বাকি চারজনের একত্রীত ধর্ষণের তথ্যটি জানা গেছে। প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান- ঘটনার পর সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল না। বরং পুলিশ ও র্যাব অভিযান চালিয়ে দ্রুততম সময়ের ভেতরে আসামিদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। পুলিশ ন্যায়বিচারের স্বার্থে তদন্তে যা যা করা দরকার সবই করেছে। ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ এমসি কলেজের ফটকে ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তারা ঢুকেছিল। ততক্ষণে আসামিরা পেছনের দেয়াল টপকে বেরিয়ে যায়। অপরদিকে গণধর্ষণের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে ইতিমধ্যে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও মহি উদ্দিন শামিম গঠিত বেঞ্চে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। গণধর্ষণের এ ঘটনার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে ২৬শে অক্টোবর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও কলেজের অধ্যক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তের দোহাই দিয়ে কলেজ কমিটির এ প্রতিবেদনটি সিলগালা করে রাখেন। তাছাড়া গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় জড়িত চার আসামির ছাত্রত্ব এবং সার্টিফিকেট বাতিল করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি তাদের স্থায়ীভাবে এমসি কলেজ থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। বহিষ্কৃতরা হলেন- সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, মাহফুজুর রহমান মাসুম ও রবিউল হাসান। এর আগে ঘটনার কয়েকদিন পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গণধর্ষণের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি এমসি কলেজে তদন্ত করতে আসে। তদন্ত শেষে তারা তাদের প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন।
অস্ত্র মামলায়ও চার্জশিট দাখিল: সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রী গণধর্ষণের ঘটনার পর ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্র উদ্ধার করেছিল পুলিশ। এই মামলায়ও সাইফুর রহমান ও শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনিকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। গতকাল দুপুরে নিজ কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) সুহেল রেজা এ তথ্য জানান। তিনি জানান- গণধর্ষণের ঘটনার রাতে ছাত্রাবাসে সাইফুর রহমানের কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে একটি পাইপগান, চারটি রামদা, দু’টি চাকু উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় শাহপরান থানায় অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়। তিনি জানান- মামলার তদন্তে ওই অবৈধ অস্ত্রগুলোর সঙ্গে সাইফুর রহমান ও মাহবুবুর রহমান রনির সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। পুলিশের অনুসন্ধানে জানা গেছে- অস্ত্রটি দিয়েছিল মাহবুবুর রহমান রনী ও জমা রেখেছিল সাইফুর রহমান। সাইফুরের ঘর থেকে ওই অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল।
আরেকটি চার্জশিট: এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনার বাইরে আরো কিছু অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল। ধর্ষণের আগে ওই গৃহবধূকে এমসি কলেজের প্রধান ফটক থেকে অপহরণ করা হয়। এরপর গৃহবধূর গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন, গলার দুল ও নগদ দুই হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। ধর্ষণের ঘটনার পর তারা প্রাইভেট কার আটকে রেখে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। প্রেস ব্রিফিংকালে উপ-পুলিশ কমিশনার সোহেল রেজা জানিয়েছেন- ধর্ষণের ঘটনার বাইরে ফৌজদারি কার্যবিধির বিভিন্ন ধারায় আরো অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে। এসব অপরাধের অভিযোগে ৮ আসামিকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। গতকাল একই সঙ্গে ওই চার্জশিটও দাখিল করা হয়।