নিভে গেল আলো

Slider সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

চলে গেলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও নাট্য ব্যক্তিত্ব আলী যাকের। গতকাল সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। আলী যাকের রেখে গেছেন স্ত্রী নাট্যজন সারা যাকের, ছেলে নাট্যাভিনেতা ইরেশ যাকের, মেয়ে রেডিও উপস্থাপক শ্রিয়া সর্বজায়াসহ অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীকে। আলী যাকের দীর্ঘদিন থেকেই দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়েছেন। পরিস্থিতির অবনতি হলে তাকে ১৭ই নভেম্বর হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল। মৃত্যুর দু’দিন আগে করোনায় আক্রান্ত হন।

গতকাল বাদ আসর বনানী গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এর আগে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বেলা সাড়ে ১১টায় আলী যাকেরের মরদেহ নেয়া হয় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে। সেখানে গার্ড অব অনার দেয়া হয় এই শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধাকে। এরপর শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয় ফুলেল শ্রদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে বেলা একটার দিকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় আলী যাকেরের কর্মস্থল এশিয়াটিক-এ।
আলী যাকেরের মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রেসিডেন্ট শোকবার্তায় বলেন, বরেণ্য অভিনেতা আলী যাকের ছিলেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার মৃত্যুতে দেশ একজন বরেণ্য অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে হারালো। তার মৃত্যু দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি।
প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তায় বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশের শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আলী যাকেরের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

১৯৭২ সালের আরণ্যক নাট্যদলের ‘কবর’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে পথচলা শুরু করেছিলেন এই নাট্যব্যক্তিত্ব। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সাল থেকে কাজ করেছিলেন নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় নিয়ে। এই দলে তিনি আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের হয়ে তিনি প্রথম নির্দেশনা দেন বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকে, যা ছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনীর যাত্রা। আলী যাকের এরপর টিভি নাটকে ব্যস্ত হন। অর্জন করেন অসীম জনপ্রিয়তা। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ নাটকে তার চরিত্রগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে আকাশছোঁয়া। এরমধ্যে তার অভিনীত আলোচিত নাটকের মধ্যে রয়েছে- ‘আজ রবিবার’, ‘বহুব্রীহি’, ‘তথাপি’, ‘পাথর’ ও ‘দেয়াল’। ‘আজ রবিবার’ ধারাবাহিকে তার অভিনীত বড় চাচা চরিত্রটি আজো দর্শকের মনে গেঁথে আছে।

অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রেও। তবে মঞ্চের সঙ্গে তার সংযুক্তি ছিল আমৃত্যু। তার অভিনীত ও নির্দেশিত মঞ্চনাটকের মধ্যে রয়েছে- ‘কবর’, ‘গ্যালিলিও’, ‘অচলায়তন’, ‘বাকী ইতিহাস’, ‘বিদগ্ধ রমণীকুল’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘কাঁঠালবাগান’, ‘তৈল সংকট’, ‘এই নিষিদ্ধ পল্লীতে’, ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’ ও ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’। আলী যাকের অভিনয়ের পাশাপাশি দেশীয় বিজ্ঞাপন শিল্পের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্বও ছিলেন। বাংলাদেশের শীর্ষ বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি-এর কর্ণধার ছিলেন তিনি। শিল্পকলায় অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদক লাভ করেছেন। আলী যাকের ১৯৪৪ সালের ৬ই নভেম্বর চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *