মধুপুরের “আউশনারা উচ্চ বিদ্যালয়ের” শিক্ষকরা করোনাকালেও অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন

বাংলার মুখোমুখি


সাইফুল ইসলাম, টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আউশনারা উচ্চ বিদ্যালয়টি অবস্থিত। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত আউশনারা উচ্চ বিদ্যালয়টি মধুপুর-কাকরাইদ-গারোবাজার-সখীপুর-ঢাকা মহাসড়কের পাশে মোটের বাজারে মনোরম পরিবেশে অবস্থিত। বিদ্যালয়ে একটি দ্বিতল ভবনসহ আরও চারটি আধাপাকা ভবন আছে এবং বিদ্যালয়ের সম্মুখে বিশাল খেলার মাঠ আছে। উপজেলা ও জেলার সাথে পাকা রাস্তায় যেকোনো যানবাহনে যোগাযোগ করা যায়।

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের দুঃসময়েও নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন দেশের সকল শিক্ষকরা। আউশনারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও পিছিয়ে নেই ; তারা করোনা পরিস্থিতিতেও অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আউশনারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ছুটে যাচ্ছেন অনলাইন ক্লাস নেওয়ার জন্য। শুধু এতেই তাঁরা সীমাবদ্ধ নন ; বাসায় বসেও তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির জন্য তৈরি করে যাচ্ছেন বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মনোমুগ্ধকর ফরম্যাটে অনলাইন ক্লাস। তাঁরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের জন্য যথাযথ মানসম্মত ও যুগোপযোগী অনলাইন ক্লাস তৈরি করছেন। আর এই সম্পূর্ণ কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে শিক্ষকদের নিজস্ব উদ্যোগে।

আউশনারা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ ও সহকারী প্রধান শিক্ষক অনন্ত কুমার আদিত্য বলেন, “বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ চলাকালীন সময়ে সকল ক্ষেত্রসহ শিক্ষাক্ষেত্রেও অনেক হোঁচট খেয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতিগুলো আংশিক হলেও পুষিয়ে নেওয়ার জন্য স্কুলটির শিক্ষকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তারা অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম চলমান রেখেছেন। এতে অনেক শিক্ষার্থী তাদের পড়ার টেবিলে মনোযোগ দিচ্ছেন। ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরও আন্তরিকতার সম্পর্ক মজবুত হচ্ছে৷ এছাড়াও প্রতিনিয়ত অভিভাবকদের নিকট শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার জোড় তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদেরকে করোনা পরিস্থিতিতেও লেখাপড়া কার্যক্রম চলমান রাখতে অত্র বিদ্যালয়টির শিক্ষকরা অনলাইন ক্লাস সহ বিভিন্নভাবে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।”

শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক যেকোনো উপায়ে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্লাস তৈরি করতে হবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকরাও সাধারণ ছুটিতে থাকবেন। কিন্তু শিক্ষক এমন একজন মহান কারিগর যিনি কোনো নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করেননা। স্থান, কাল, পাত্র চিন্তা না করে যেকোনো জায়গা থেকেই তারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। তাঁদের কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দেয়া আর তারা সব প্রতিকূল অবস্থাতেই নিজস্ব কাজে অটল।

আউশনারা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক শ্যাম সুন্দর আদিত্য জানান, “প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে আমরা এপ্রিল মাস থেকেই অনলাইন ক্লাস শুরু করেছিলাম। প্রথম দিকে তেমন সাড়া না পেলেও পরবর্তীতে অত্র বিদ্যালয়ের ৮০% শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হয়৷ আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে আমরা যে অনলাইন ক্লাস শুরু করেছিলাম তা অনেকাংশে সফল হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরাও অনেক উপকৃত হয়েছেন”।

অত্যন্ত সাবলীলভাবে ও চমৎকারভাবে তৈরি করা হচ্ছে এক এক ভিডিও। সকল শ্রেণিশিক্ষক প্রতিটি শিক্ষার্থীকে এক এক করে ফোন করে ক্লাসের ব্যাপারেও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। যেসব শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নেই তাদের মোবাইল ফোনে পড়া বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।এছাড়াও অনলাইন পাঠদানের পাশাপাশি অনুপ্রেরণামূলক, উপদেশমূলক বিভিন্ন কথাবার্তা ও আলোচনা করে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের মনোবল বাড়াচ্ছেন স্কুলটির শিক্ষকরা।

আউশনারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শ্রেণি শিক্ষক রুবেল সরকার জানান, “করোনাকালেও শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে যাচ্ছি। করোনাকালে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানাবো করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের স্কুলে একটি ভবন এবং কম্পিউটার ল্যাব স্থাপনের জন্য কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।”

মানসম্মত শিক্ষক, মানসম্মত শিক্ষা উপকরণ ও মানসম্মত শিক্ষা পরিবেশ হলো গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার মূল উপাদান। এই তিনটি উপাদানের মধ্যে শিক্ষকই একমাত্র চলক যার উপর অন্যান্য উপাদানের ভালোমন্দ নির্ভর করে। আর এই শিক্ষকই আমাদের সমাজের বিবেক। তাই সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা সবার উপরে।

স্কুলটির সহকারী শিক্ষক আব্দুস সালাম জানান, “করোনা সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসাইনমেন্ট জমা দিতে শিক্ষার্থীদের স্কুলে আসার জন্য অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছি। এছাড়াও তাদেরকে উদ্ভুদ্ধ করে যাচ্ছি যেন বাড়িতে রুটিন মাফিক পড়ালেখা চালিয়ে যায়”।

শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল সৌন্দর্য। বর্তমানে লেখাপড়া বন্ধ করে অন্যরা যেখানে বসে আছে সেখানে ব্যতিক্রমী এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা। তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামীণ পর্যায়ে থেকেও অন্য সকল শিক্ষার্থীদের চেয়ে এগিয়ে। আউশনারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানান, “আমাদের শিক্ষকরা কোভিড-১৯ চলাকালীনও পড়ালেখা চালিয়ে যেতে অনেক উৎসাহ, প্রেরণা যোগাচ্ছেন। তারা অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে পাঠদান করাচ্ছেন। ভালো-মন্দ, ভুল-সঠিকের দৃষ্টিভঙ্গি শেখাচ্ছেন। তাই আমরা বর্তমানে মোটামুটি অনলাইন ক্লাসের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি।”

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অভিভাবকবৃন্দরা স্কুলটির শিক্ষকবৃন্দের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “স্কুল বন্ধ থাকা অবস্থায় আমাদের সন্তানরা কীভাবে পড়াশোনা করবে ও তাদের পাঠ্য কার্যক্রম নিয়ে আমরা খুবই চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু স্কুলটির শিক্ষকরা অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে আমাদেরকে চিন্তামুক্ত করে দিয়েছেন।”

উল্লেখ্য যে, এমন গ্রামীণ পর্যায়ে অবস্থিত আউশনারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমন সূদুরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা সকলকেই অবাক করে তুলেছে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, অনেকেই কল্পনাও করতে পারেন নি যে এই স্কুলটি অনলাইন ক্লাস পরিচালনায় এতদূর এগিয়ে যাবে। আউশনারা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *