ম্যাজিক ফিগারের কাছাকাছি বাইডেন

Slider সারাবিশ্ব

খেলাটি তিন অঙ্কের। টোটাল ফিগার ৫৩৮। টার্গেট ২৭০। ম্যাজিক ফিগার। বাজিতে হেড বা টেইল যা-ই ধরুন না কেন? বিজয় মুকুট তিনিই পরবেন, যিনি ছুঁতে পারবেন সেই ম্যাজিক ফিগার। কিন্তু কে ছুঁবেন? মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। আর এর উত্তর পেতে তামাম দুনিয়ার ছয় শ’ কোটি মানুষের ঘুম হারাম। কিন্তু মাঝখানে আদালত এসে সেই নির্ঘুম রাতকে আরো দীর্ঘ করে দিলো।

আবারো প্রশ্ন-হোয়াইট হাউস কতদূর? বাইডেনের স্বপ্ন কি দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেবে? যেকোনো থ্রিলার উপন্যাসের চেয়েও এ যেন অনেক বেশি উত্তেজনাকর। অনেক বেশি থ্রিলিং। থেমে নেই বাজিকররাও। হাজারো জিজ্ঞাসা আর উদ্বেগে টানটান উত্তেজনা। ২৭০ ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের জন্য ২৬৪তে আটকে থাকায় সেই ম্যাজিক ফিগারের কাছাকাছি পৌঁছলেন জো বাইডেন।

১৯৮৮ সালে বাইডেন ডেমোক্রেট দলের হয়ে মনোনয়ন চেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট পদের। দশকের পর দশক অপেক্ষা। এক দশক, দু’ দশক নয়- টানা ৩২ বছর। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সেই ম্যাজিক ফিগারের কাছাকাছি বাইডেন। রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন এরও আগে ১৯৭০ সালে। হয়েছিলেন কাউন্সিলম্যান। সেই থেকে আমেরিকান জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। আমেরিকাবাসীও খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। পাঁচ দশক পরে বাইডেনের লড়ে যাওয়ার শক্তিকে সম্মান জানিয়েছে। বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে উত্তেজনাকর নির্বাচনে শেষ হাসিটি জো বাইডেনই কি হাসবেন! মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়ার রেকর্ডও তারই। আরো এক ইতিহাসকে সঙ্গী করেছেন তিনি।

হাল না ছাড়া এক বাইডেন: জো বাইডেন। গোটা বিশ্বে আজ চেনা এক নাম। দুনিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু সাদা দালানে পৌঁছতে নানা বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে মানুষটিকে। দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। ১৯৮৮ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে মাঠে নেমেছিলেন। মনোনয়ন চেয়েছিলেন ডেমোক্রেট দলের। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে, তিনি অন্যের লেখা চুরি করে নিজের নামে চালিয়েছেন! আর এই অভিযোগের সূত্র ধরে আরেকটা অভিযোগ সামনে আনা হয়। ছাত্র জীবনের একটি ঘটনা, যখন তিনি আইনের ছাত্র হিসেবে তার সাইটেশন পেপারে আরেকজনের লেখা হুবহু ব্যবহার করেছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন, সেটা যে নিয়মবহির্ভূত তা তিনি জানতেন না। এমন অসততার অভিযোগ আনা হলে তিনি প্রচারণা থেকে সরে দাঁড়ান!

পরে তার জীবনীকারকে বাইডেন বলেছিলেন, ‘ওই ঘটনা তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। নিজেকে চিরকাল একজন সৎ মানুষ হিসেবে মনে করেছি। সেই জায়গাটা বিরাট ধাক্কা খেয়েছে।’
বাইডেন তার বায়োগ্রাফির আরেক জায়গায় লিখেছেন, ‘এর জন্য দায়ী আমি নিজে। নিজের ওপর রাগ আর হতাশায় ভুগছি। আমেরিকার মানুষকে আমি কীভাবে বোঝাবো এটাই জো বাইডেনের আসল পরিচয় নয়। এটা শুধু আমার মস্ত একটা ভুল!’

এরপর স্বজন হারানো, স্ত্রী-পুত্রবিয়োগ, নিজের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণসহ নানা সংকটে আরো ২০ বছর নিজের সঙ্গে সংগ্রাম করেন বাইডেন। এর মাঝে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছেন তার থেকে বয়সে কনিষ্ঠ অনেকে, বিল ক্লিনটন, জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা ও ট্রাম্প!

বিশ বছর পর ২০০৮ সালে ফের দলীয় মনোনয়ন দৌড়ে নামেন। বারাক ওবামার সঙ্গে পেরে উঠেননি। রন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ২০১৬ সালের নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন পাননি, হিলারির কাছে হেরে যান। সে যাত্রায় প্রেসিডেন্ট হন রিপাবলিকান দলের ডনাল্ড ট্রাম্প।

কিন্তু হাল ছাড়েননি বাইডেন! তার স্বপ্ন ছিল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন। অবশেষে ২০২০ সালে লাভ করেন প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন। সেখানেও অনিশ্চয়তা ছিল। মনোনয়ন পেতেই যেন হেরে যাচ্ছিলেন। একেবারে শেষ মুহূর্তে মনোনয়ন পান। এমনই হাল না ছাড়া মানুষ জো বাইডেন।

জো বাইডেন প্রায়ই একটি কথা বলেন, ‘বাবার একটা কথা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা- ‘কে তোমাকে কতবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো, সেটা বড় কথা নয়, কত দ্রুত তুমি উঠে দাঁড়াতে পারলে, মানুষ হিসেবে সেটাই হবে তোমার সাফল্যের পরিচয়।’

ফক্স নিউজের হিসাবে ২৬৪ ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট নিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকেন জো বাইডেন। তখন ট্রাম্প অবস্থান করছিলেন ২১৪তে। হোয়াইট হাউসের চাবি নিজের কাছে রাখতে হলে তাকে বাকি সব কয়টি রাজ্যে জিততে হবে। সেক্ষেত্রে জো বাইডেনের জন্য হিসাবটা অনেক সহজ হয়ে যায়। তিনি নেভাদায় এগিয়ে ছিলেন। এ রাজ্যে ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট ৬টি। শেষ পর্যন্ত এখানে জো বাইডেন জয়ের দ্বারপ্রান্তে।

নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প শিবিরের আইনি চ্যালেঞ্জ কি তাকে থামাতে পারবে? এমন অসংখ্য প্রশ্ন থাকলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রে উত্তেজনা তুঙ্গে। এরই মধ্যে ট্রাম্প সমর্থকরা রাইফেল, হ্যান্ডগান ব্যবহার করে বিক্ষোভ করেছেন অ্যারিজোনায়। ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে নিউ ইয়র্ক, পোর্টল্যান্ড, অরিগনে। আরো বিক্ষোভের কর্মসূচি রয়েছে। ফলে টান টান উত্তেজনা চারদিকে। এরই মধ্যে ক্রমশ ম্লান হতে থাকে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা। তিনি ভোট জালিয়াতির অভিযোগ করেছেন। ভোট বন্ধের দাবিতে মামলা করেছেন। দাবি করেছেন ভোট নতুন করে গোনার। অ্যারিজোনার ফিনিক্সে একটি নির্বাচনী অফিসের বাইরে রাইফেল, হ্যান্ডগানসহ বিক্ষোভ করেছে ট্রাম্পের প্রায় দুইশ’ সমর্থক। এদিকে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে বিভিন্ন শহরে। পুলিশ নিউ ইয়র্ক সিটি, পোর্টল্যান্ড, অরিগনে এমন বিক্ষোভ থেকে বেশকিছু বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। বুধবার থেকে শনিবারের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ট্রাম্পবিরোধী শতাধিক ইভেন্ট পরিকল্পনা করা হয়েছে। সবকিছু মিলে এবার যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তীব্র এক উত্তেজনা বিরাজ করছে। আগেভাগেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা সতর্ক করেছেন সবাইকে। দোকানপাটে বাড়তি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয়েছে নিরাপত্তারক্ষী। এ খবর দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবার ব্যতিক্রমী সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। আগে থেকেই নির্বাচন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার হুমকি দেয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সত্যি আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন কয়েকটি রাজ্যে। এবার ফল ঘোষণায় বিলম্ব হয়। এর কারণ হলো মেইলে পাওয়া ভোট। এগুলো গণনায় বাড়তি সময় লাগে। এ জন্য ভোট গণনা বা ফল ঘোষণায় বিলম্ব হলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একে দেখেছেন ‘জালিয়াতি’ হিসেবে। তিনি যখন এ অভিযোগ করেন তখন অনলাইন ফক্স নিউজের হিসাবে ২৬৪টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পেয়ে হোয়াইট হাউসের খুব কাছে চলে গেছেন জো বাইডেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে তার আর প্রয়োজন মাত্র ৬টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট। যে রাজ্যগুলোতে ভোটের ফল তখনও আটকে ছিল, সেখানে মেইলে যারা ভোট দিয়েছেন, তার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই ডেমোক্রেট। ফলে এর মধ্যে যেকোনো একটি রাজ্যে বাইডেন বিজয়ী হলেই তার হোয়াইট হাউসের টিকিট নিশ্চিত হয়ে যাবে- এমন বিশ্লেষণ চলতে থাকে। অন্যদিকে ট্রাম্প ২১৪ ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট নিয়ে তাকে পিছু ধাওয়া করছিলেন। তবে রয়টার্সের হিসাবে তখন নেভাদা ও অ্যারিজোনায় সামান্য ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন ৭৭ বছর বয়সী জো বাইডেন। অন্যদিকে পেনসিলভ্যানিয়া ও জর্জিয়াতে খুবই সামান্য ভোটের ব্যবধানে ট্রাম্প এগিয়ে। নর্থ ক্যারোলাইনায়ও সামান্য ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। বিশ্লেষণে বলা হয়, এসব রাজ্যের মধ্যে একটিও যদি ট্রাম্পের হাতছাড়া হয় তাহলেই জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট। এসব রাজ্য গত নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন ট্রাম্প। বলা হয়, যদি তিনি এবার সেই ধারা অব্যাহত রাখতে ব্যর্থ হন তাহলে ১৯৯২ সালের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের পর তিনিই হবেন প্রথম ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট, যিনি ক্ষমতায় থাকতে পরাজিত হয়েছেন। ওদিকে বুধবার বিজয়ের পূর্বাভাস দিয়েছেন বাইডেন। তিনি এদিন ডেমোক্রেট নিয়ন্ত্রিত হোয়াইট হাউস মিশন পরিচালনা করার জন্য ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য একটি ওয়েবসাইট চালু করেছেন।

ওদিকে নির্বাচনের রাতে যখন ৬টি রাজ্যে ভোট গণনার বাকি, তখন নিজের বিজয় ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তার এমন ঘোষণাকে ‘ফলস্‌লি’ বলে অভিহিত করেছে বিভিন্ন মিডিয়া। তিনি অনিয়মের অভিযোগে যে আইনি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন, তাকে ‘অহেতুক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি বিরল বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। উইসকনসিনে বিজয়ী হয়েছেন জো বাইডেন। সেখানে নতুন করে ভোট গণনা করে ট্রাম্পের পরাজয় ঠেকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে ট্রাম্প টিম। অন্যদিকে মিশিগান ও পেনসিলভ্যানিয়ায় ভোগ গণনাকে বন্ধ রাখার জন্য তারা আইনি ব্যবস্থা নেয়। এমন অবস্থাকে মিশিগানের সেক্রেটারি অব স্টেট জোসেলিন বেনসন ‘অহেতুক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। জর্জিয়াতে ভোট গণনা বন্ধ রাখার দাবিতে তারা আইনি ব্যবস্থা নেয়। এ জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানায়, যাতে পেনসিলভ্যানিয়াতে রিপাবলিকানদের করা মামলার কার্যক্রমে যোগ দিতে পারেন ট্রাম্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *