ট্রাম্পের কূটনৈতিক সম্পর্কের পোস্টমর্টেম

Slider বিচিত্র

উত্তর কোরিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু। সর্বত্রই নিজস্ব ধরণের রাজনীতির প্রভাব বিস্তার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। বলা হচ্ছে অফগানিস্তান, সিরিয়া ও উপসাগরীয় অঞ্চলে তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে। তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা রক্ষা করতে পারেননি। ২০১৭ সালের শুরুতে উত্তরসূরি হিসেবে যখন ট্রাম্পের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, তখন তিনি বিশেষ করে একটি ইস্যুতে জোর দিয়েছিলেন। ওবামা বলেছিলেন, উত্তর কোরিয়া এবং তার পারমাণবিক কর্মসূচি হলো একটি জটিল বিষয়। ক্ষমতায় এসেই প্রথম দুই বছর এখাতে প্রচুর সময় খরচ করেছেন ট্রাম্প।

প্রথমদিকে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করে মন্তব্য করেছিলেন। তার নাম দিয়েছিলেন লিটল রকেট ম্যান। আবার কিছুদিন পরে তিনি সেই কিম উন জংকেই অত্যন্ত চমৎকার ব্যক্তি বলে প্রশংসা করেন এক চিঠিতে। তিনবার তাদের মধ্যে মুখোমুখি সাক্ষাত হয়েছে। এর মধ্যে দু’বার তাদের আনুষ্ঠানিক সাক্ষাত হয়েছে। এতে আশা জেগে উঠেছিল যে, এই দুই দেশের মধ্যে বুঝি বৈরিতা কেটেই গেল আর উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক কর্মসূচি ত্যাগ করলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর কোনোটাই হয়নি।
এসপেন ইনস্টিটিউট জার্মানির নির্বাহী পরিচালক রুদিগার লেনটজ বলেন, বিপক্ষ তাকে নিয়ে একরকম গেম খেলেছে, তা হয়তো পুরোপুরি বুঝতে পারেননি ট্রাম্প। ফলে তিনি যা করলেন, তা হলো দ্রুততার সঙ্গে একটি চুক্তি। তিনি সব সময় আসলে এটাই চাইছিলেন। তবে কিছুটা যে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে এটা মানতে হবে। অন্তত এ দুটি দেশ আলোচনার একটি ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন- উভয় দেশই দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেছে। চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করেছেন ট্রাম্প। লেনটিজ বলেন, করোনা ভাইরাস মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করছে চীন। এটা তাদেরকে একটি সুবিধা দিয়েছে। ফলে কয়েক মাস বা বছর খানেক আগে ট্রাম্পের যে অবস্থান ছিল তা আরো দুর্বল হয়েছে। পূর্বসুরির সঙ্গে তুলনা করলে ট্রাম্প কখনো চীনের মানবাধিকার ইস্যুতে আগ্রহ দেখাননি। তার সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টনের মতে, সিনজিয়াং অঞ্চলে মুসলিম উইঘুরদের ‘বন্দি শিবিরে’ আটকে রেখে তাদেরকে শিক্ষিত করে তোলার যে কথা বলছে চীন, সে বিষয়ে ট্রাম্পের কোনো উদ্বেগ ছিল না।

আশা করা হয়েছিল ট্রাম্পের অধীনে আফগানিস্তান শান্তির কাছাকাছি চলে আসবে। ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে তালেবানরা। এর ফলে প্রায় দুই দশক ধরে চলমান যুদ্ধের ইতি ঘটবে বলে আন্তর্জাতিকভাবে মনে করা হয়েছিল। এই চুক্তিতে ধারণা করা হয়েছিল তালেবানরা যদি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাহলে আফগানিস্তান থেকে সেনাদের প্রত্যাহার করবে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে আফগান সরকারের সঙ্গে সমঝোতামূলক আলোচনায় আছে তালেবানরা। ট্রাম্পও কথা দিয়েছেন তিনি বড়দিনের মধ্যে মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে নেবেন। তা সত্ত্বেও আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এখনও ভঙ্গুর। লেনটজ বলেছেন, ট্রাম্প যা অর্জন করেছেন তা হলো, সেনা প্রত্যাহারের একটি অজুহাত। কিন্তু মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহার করা হলে ওই অঞ্চল আরো সংঘাতময় হয়ে উঠবে। এমনও হতে পারে তালেবানরা আবার ক্ষমতায় ফিরে যেতে পারে।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প বলেছিলেন, আমরা কুর্দিদের রক্ষা করতে চাই। আমি সারাজীবন সিরিয়ায় থাকতে চাই না। সেটা হলো বালুতে দাঁড়িয়ে থাকা। সেটা হলো মৃত্যু। অবশেষে এ বছর অক্টোবরে তিনি উত্তর সিরিয়ায় কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে ব্যাপক হারে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স-এর মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক কর্মসূচির পরিচালক জুলিয়েন বারনেস ডাসি বলেন, ট্রাম্পের নীতির ফলে প্রেসিডেন্ট এবং তার প্রশাসনের সদস্যদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এই বিভক্তির কারণে সিরিয়ায় মার্কিন কৌশল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ফলে সেখানে রাশিয়ানদের জন্য এক চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এর আগে কখনো রাশিয়ার জন্য এভাবে মুক্তাঞ্চল ছেড়ে দেয়নি। লেনটজ মনে করেন, এটাই হলো ট্রাম্পের নীতি । তিনি মনে করেন, যদি ৩রা নভেম্বরের নির্বাচনে জো বাইডেন বিজয়ী হন, তাহলে তাকে ডেমোক্রেটিক পার্টিকে অধিক মস্কোবিরোধী অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে।
আট বছর ক্ষমতায় ছিলেন বারাক ওবামা। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তেমন বড় কোনো হুমকি হিসেবে দেখা হয়নি ইরানকে। পারমাণবিক কর্মসূচির বিশাল অংশ ভেঙে ফেলতে রাজি হয়েছিল ইরান। বিনিময়ে তাদেরকে অবরোধ প্রত্যাহারের পথ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প মনে করলেন বহুজাতিক ওই পারমাণবিক চুক্তি ইরানের জন্য খুবই কমনীয়। ফলে তিনি ওই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আরোপ করেন আরো শক্তিশালী অবরোধ। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি এমন একটি চুক্তি চান যা ইরানের পক্ষে যাবে না।
অতঃপর ২০২০ সালের শুরুতে ইরানের কুদস বাহিনীর কমান্ডার কাসেম সুলাইমানিকে টার্গেট করে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। এতে দুই দেশ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌছে যায়। লেনটজ বলেন, আমি মনে করি না যে, আমরা নতুন একটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে আছি। তবে আমরা সীমিত সামরিক একশনের কাছাকাছি রয়েছি। এমন কৌশল ট্রাম্প আসলে পছন্দও করেন। আমার মনে হয়, তাকে এক্ষেত্রে ফিরে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন তার উপদেষ্টারা। তারা তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে যে, এমন কোনো হামলা চালালে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অথবা একটি বিরাটকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। তবে ইরান বা যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষের কোনো যুদ্ধে আগ্রহ আছে বলে মনে করেন না বারনেস ডাসি। এক্ষেত্রে আরব রাষ্ট্রগুলো ট্রাম্পের কঠোর অবস্থানের পক্ষে থাকলেও, হয়তো শেষ মুহূর্তে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, ইরানে হামলা চালালে তাতে আঞ্চলিক এক বিস্ফোরণ ঘটবে। চড়া মূল্য দিতে হতে পারে পুরো অঞ্চলকে।

ইসরাইলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিযে জেরুজালেমে নিয়েছেন ট্রাম্প। এই জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনিরা তাদের ভবিষ্যত রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দাবি করেন। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বসতি সম্প্রসারণের পরিকল্পনাকে সমর্থন দেন ট্রাম্প। যখন ট্রাম্পের জামাই জারেড কুশনার জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউজে তার শান্তি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। কোনো ফিলিস্তিনি নেতা উপস্থিত ছিলেন না। মধ্যপ্রাচ্যে এবং উত্তর আফ্রিকায় ইসরাইলের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দিয়েছে মার্কিন সরকার। এরই মধ্যে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে রাজি হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও সুদান। ট্রাম্প দাবি করেছেন, এরপর এতে সম্মতি দেবে সৌদি আরব। বারনেস ডাসি বলেন, জারেড কুশনারের প্রস্তাবের মতো, এসব চুক্তি কোনে ফিলিস্তিনি নেতার সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই করা হয়েছে। তাই আমার মনে হয়, শান্তি প্রক্রিয়াকে হত্যার কার্যকর উপায় অবলম্বন করেছেন ট্রাম্প। কারণ, এতে দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান হওয়ার পথ থাকবে না।

ওদিকে সৌদি আরব উদ্বেগে। কারণ, যদি জো বাইডেন নির্বাচিত হন তাহলে তারা আরবে যে প্রভাব বিস্তার করে আছেন তাতে বিঘœ সৃষ্টি হতে পারে। সৌদি আরবে যেসব ভয়াবহ অপরাধ ঘটে সেদিকে দৃষ্টি দিতে পারেন বাইডেন। যেমন ২০১৮ সালে তুরস্কে সৌদি আরবের একজন সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা।
(অনলাইন ডয়েছে ভেলে অবলম্বনে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *