নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেটে কারা?

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

ঢাকা: অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বেসামাল নিত্যপণ্যের বাজার। দামের চাপে জেরবার সাধারণ ক্রেতারা। করোনার কারণে চাপে পড়া সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো কঠিন করে তুলেছে নিত্যপণ্যের মূল্য। পিয়াজ থেকে শুরু করে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আলু, মরিচ, ডিম ও সব ধরনের সবজি কিনতে ভোক্তাকে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। বাজারে সরবরাহ থাকলেও ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি পিয়াজ দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাকে। ২০-২২ টাকার আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৫০-৫৫ টাকা। ৫০ থেকে ৬০ টাকার নিচে মিলছে না কোনো সবজি। এর মধ্যে চালের দাম কমাতে খাদ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও বাজারে এর প্রভাব তেমন একটা পড়ছে না।

বিশ্লেষকরা জানান, করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে অসাধু সিন্ডিকেট। সুযোগ বুঝে তারা বিনা কারণেই আলুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এই অশুভ চক্র চাল, পিয়াজ ও সয়াবিন তেলও সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে। এর মধ্যে শুধু চালেরই ৪৩৬ জন মিল মালিক দাম বাড়ানোর কারসাজিতে জড়িত বলে মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এরা সবাই ক্ষমতাসীন দলের জড়িত বা প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কারও কারও রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। শুধু কি চাল? অন্যসব নিত্যপণ্যের বাজারও নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেট যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারা প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। ক্ষমতাসীন দলের পরিচয় বা এমপি, মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন পরিচয়ে ব্যবসা করছেন তারা। এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে

বাজারে বেসামাল অবস্থা। এতে ক্ষোভ বাড়ছে সাধারণ মানুষের মাঝে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজেদের স্বার্থ লুটতে এই মুনাফাখোর সিন্ডিকেট সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যে বা যারাই নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট করে মুনাফা লুটছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কারণে আলুর দাম বেড়েছে। আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে। ব্যবসায়ীরা নৈতিকতার বাইরে গিয়ে প্রতি কেজি আলুতে অন্তত ২০ টাকা লাভ করছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসন চেষ্টা করে। তবে বাস্তবে এটা করা যায় না। বাজারে চাহিদা ও তাদের (ব্যবসায়ী) নানান কারসাজির কাছে এটা করা খুব কঠিন একটা কাজ। তবে আমরা চেষ্টা করছি। আমরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছি না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গত মওসুমে ধানের রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। এ অবস্থায় চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। অতি মুনাফালোভী মিলারদের কারসাজিতে ঢাকায় প্রতি বস্তা চালে (৫০ কেজি) ২৫০ ও চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ৩৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও আমদানিকারকদের কারসাজিতে প্রতিকেজি পিয়াজ সর্বোচ্চ ১০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আলুর দামও লাগামহীন। এই তিনটি নিত্যপণ্য কিনতে প্রায় দ্বিগুণ বেশি খরচ গুনতে হচ্ছে ভোক্তাকে। পাশাপাশি বাজারে আকাশচুম্বী সব ধরনের সবজির দাম। এ ছাড়া ডিম, ভোজ্যতেল ও আদাসহ মসলা জাতীয় পণ্য বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দরে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি রোধে চালের পর আলুর দাম নির্ধারণ করেছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার এবং বাজারে নজরদারির অভাবে এখনো বাড়তি দরেই আলু বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, যার যেভাবে মন চায় সেভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। যে কারণে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর দাম নির্ধারণ করলেও এর কোনো সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা। বাজারে প্রতি কেজি আলু ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। সেখানে কোনো খুচরা ব্যবসায়ী সরকারের বেঁধে দেয়া দামে এটি বিক্রি করেনি। বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে এসে খালেদ বলেন, সরকার খুচরা পর্যায়ে আলুর দাম প্রতি কেজি ৩০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বাজারে এসে কোনো দোকানে ৩০ টাকায় আলু কিনতে পারিনি। তিনি জানান, বাজারে যে সব সংস্থা তদারকি করবে তাদেরও দেখা নেই। সেই সুযোগে বিক্রেতারা আগের দামেই বিক্রি করছেন।

খুচরা চাল বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৫৬-৫৮ টাকা। যা ২০ দিন আগে ছিল ৫৩-৫৪ টাকা। বিআর-২৮ চাল বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকা, আগে ছিল ৪৬-৪৭ টাকা। মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৫০-৫২ টাকা, আগে ছিল ৪০-৪২ টাকা।

কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, নীরবে মিলাররা প্রতি বস্তা চালে ২০০-২৫০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। যার প্রভাবে পাইকারি বাজারে দাম বেড়েছে। তিনি জানান, কোনো অজুহাত পেলেই তারা দাম বাড়ায়। তাই বাজার এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। যে কারণে মিলাররা সিন্ডিকেট করে সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে চালের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও মিলাররা তা অমান্য করছে। তারা তাদের ক্ষমতা দেখিয়ে সরকারের বেঁধে দেয়া দামে চাল বিক্রি করছে না। যার কারণে বাজারে চালের দাম কমছে না।

রাজধানীর খুচরা বাজারে ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল কোম্পানিভেদে সর্বোচ্চ ৫২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা এক মাস আগে ছিল সর্বোচ্চ ৫১০ টাকা। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৯৪ টাকা, আগে ছিল ৮৮ টাকা। প্রতি লিটার পাম অয়েল (সুপার) বিক্রি হয়েছে ৮৯ টাকা, আগে ছিল ৭৫ টাকা। প্রতি কেজি আমদানি করা আদা বিক্রি হয়েছে ২৪০-২৬০ টাকা, এক মাস আগে ছিল ২২০-২৪০ টাকা। দেশি আদা প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা, আগে ছিল ১৪০-১৫০ টাকা। এ ছাড়া খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ৯০-১০০ টাকা। যা ১০ দিন আগে ছিল ৮৫-৯০ টাকা। আমদানি করা পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০-৮০ টাকা, আগে ছিল ৬৫-৭০ টাকা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এটি স্বাভাবিক নয়। তার মতে, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে একজন আরেকজনকে দোষ দেয়। তবে বিষয়টি নজরদারির দায়িত্ব সরকারের। তিনি বলেন, কোনোরকম কারসাজি হলে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল জব্বার মণ্ডল বলেন, নিত্যপণ্যের দাম কমাতে অধিদপ্তরের একাধিক টিম তদারকি করছে। কোনো অনিয়ম পেলে সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কাউকেই ছাড় দেয়া হচ্ছে না। আশা করি, কয়েকদিনের মধ্যে দাম কমে আসবে।

এদিকে ক্রেতারা শুধু বাজারেই ক্ষোভ প্রকাশ করে থামেননি অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী ফেসবুকে লেখেন, দেশে সব থেকে সস্তা খাবার বা গরিবের খাবার সবাই মনে করতো ভাতের সঙ্গে কাঁচামরিচ দিয়ে তৈরি আলুভর্তা। কিন্তু মনে হচ্ছে এই খাবার এখন বিলাসিতার স্থান দখল করেছে। কারণ এক কেজি মরিচ এখন ২৫০-২৮০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। খুচরা বাজারে আলুর কেজিও প্রায় ৬০ টাকা। পাশাপাশি সব ধরনের চালের দাম বাড়তি। বিশেষ করে মোটা চাল এখন প্রতি কেজি ৫০-৫২ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এতে মনে হচ্ছে, এই খাবার এখন গরিবের বললে খুব বেশি ভুল হবে। এটা এখন ধনীদের খাবার।
কাওরান বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা গৃহিণী আসমা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সব পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। এই দাম বাড়ার পেছনে কি কোনো যৌক্তিক কারণ আছে? এসব বিষয়ে যে বা যারা তদারকি করবে সবাই নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। এ সুযোগে অসাধুরা একটি একটি করে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে।

কনসাস কনজুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, যেকোনো অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। সিন্ডিকেট করে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই প্রতি সপ্তাহে একটি একটি করে প্রায় সবগুলো পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে একসঙ্গে সব ধরনের পণ্যে বাড়তি দর গুনতে ভোক্তার ওপর বেশ চাপ পড়ছে। যে কারণে ভোক্তারা পণ্য কিনতে এসে দিশাহারা হয়ে পড়ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *