নদীতে হারিয়ে গিয়েছিলেন মৃণালিনী

Slider জাতীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

ঢাকা: ১৮৯৮ সালের ৩ অগস্ট পাঁচ ছেলেমেয়েকে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে জোড়াসাঁকো থেকে শিলাইদহে বসবাসের জন্য গেলেন মৃণালিনী। গৃহবিদ্যালয় খুলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখানোয় সেখানে যেমন মন দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাদের স্বনির্ভর করে তুলতে ঘরের কাজ শিখিয়েছিলেন মৃণালিনী।

রবিবার বাড়ির কাজের লোকদের ছুটি দিতেন তিনি। কাজেই বাড়ির কাজে সেদিন হাত লাগাতে হতো সকলকে। রবীন্দ্রনাথ যেমন দুর্বল ছিলেন তাঁর দরিদ্র প্রজাদের প্রতি, গরিব মানুষ সাহায্যপ্রার্থী হলে তাঁকে ফেরাতে পারতেন না মৃণালিনীও।

এভাবেই রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতেই শিলাইদহে এক দরিদ্র পাঞ্জাবি মূলা সিংহকে মাসিক পনেরো টাকা মাইনেতে বাড়ির দারোয়ানের চাকরি দিয়েছিলেন মৃণালিনী। ঠাকুর এস্টেটের স্বল্পবেতনভোগী আমলা আর কর্মীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে খুলে দিয়েছিলেন একটি মেস। কুঠিবাড়িতেই নিজে করেছিলেন শাক সবজির বাগান।

বলেন্দ্রনাথকে খুবই স্নেহ করতেন মৃণালিনী। শিলাইদহে একবার বলেন্দ্রনাথ আর এক সহচরীকে নিয়ে প্রকৃতি আর পাখির টানে পদ্মায় হারিয়ে যান মৃণালিনী।
বহু চেষ্টার পর একদল মৎস্যজীবীর কল্যাণে তাঁরা ফেরার পথ খুঁজে পান।

পদ্মার বোটে কখনও সন্ধ্যে হলেই সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর সুর বাঁধতেন এস্রাজে। পালা করে গান গাইতেন রবীন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা। শিলাইদহে মৃণালিনীর দুই প্রিয়পাত্র বলেন্দ্রনাথ ও নীতিন্দ্রনাথের অকাল মৃত্যুতে গভীর শোক পেয়েছিলেন কবি-পত্নী। বলেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরই আর শিলাইদহে থাকতে চাননি মৃণালিনী। চলে আসেন প্রথমে কলকাতায়। তারপরে শান্তিনিকেতনের নির্জনতায়।

একেবারেই সাধারণ সাজগোজে থাকতেন মৃণালিনী। খুব বেশি সাজগোজ পছন্দ করতেন না রবীন্দ্রনাথ নিজেও।

সম্ভবত তাই তাঁর সামনে গয়নাগাটি পরতেও লজ্জা পেতেন মৃণালিনী। হেমলতা ঠাকুর লিখেছেন, একদিন তাঁদের ধরাধরিতে দুই কানে দুই দুল ঝোলানো বীরবৌলি পরেছিলেন মৃণালিনী। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ এসে পড়ায় দুই হাত চাপা দিয়ে আড়াল করে ফেললেন দুল। সমবয়েসি বাড়ির বৌদের সাজতে বলেও মৃণালিনী নিজে থাকতেন অতি সাধারণভাবে।

তবে তাঁর হয়ত ইচ্ছে হতো রবীন্দ্রনাথকে একটু সাজিয়ে দেবার। স্বামীর জন্য তাঁর জন্মদিনে একবার সাধ করে গড়িয়ে আনলেন সোনার বোতাম।

রবীন্দ্রনাথ দেখে বললেন, ‘ছি ছি ছি, পুরুষে কখনো সোনা পরে– লজ্জার কথা!’

শুনে, মৃণালিনী সেই বোতাম ভেঙে ওপাল বসানো বোতাম গড়িয়ে দিলেন। আর প্রায় দায়ে পড়ে সেই বোতাম কিছু দিন ব্যবহার করলেন রবীন্দ্রনাথ।

আর একবার, বিয়ের তিন মাস পর, কলকাতা জাদুঘরের প্রথম প্রদর্শনী দেখতে অন্যদের সঙ্গে যাবেন মৃণালিনী। পরেছেন বাসন্তী রঙের জমিতে লাল ফিতের উপর জরির কাজ করা পাড় বসানো একটা শাড়ি। হাতে একটা পাত্রে মিষ্টি খেতে খেতে হাজির হলেন রবীন্দ্রনাথ। সুন্দর সাজে মৃণালিনীকে দেখে তারপর চড়া সুরে গেয়ে উঠলেন, ‘হৃদয়কাননে ফুল ফোটাও,/ আধো নয়নে সখি, চাও চাও!’

মৃণালিনী দুই মেয়ের বিয়ে দেখে গিয়েছিলেন। বিয়ের পরই তাকে দেখতে হয়েছিল কাদম্বরী দেবীর অস্বাভাবিক মৃত্যু। সম্ভবত নীরবেই তিনি সামলেছিলেন স্বামীর প্রিয়বৌঠানের অপমৃত্যুর গভীর সেই শোক।

রবীন্দ্রনাথের মতো নিজের সন্তানদের মৃত্যু অবশ্য দেখে যেতে হয়নি মৃণালিনীকে।

বড় মেয়ে বেলা আর মেজকন্যা রেণুকার বিয়ে দেখে যেতে পেরেছিলেন।

কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী পণ নিয়ে ছেলে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন পনেরো বছরের কন্যা মাধুরীলতার।

পণ নিয়ে পাত্রপক্ষের রীতিমতো দর কষাকষিতে বিরক্ত হয়েছিলেন মৃণালিনী। বিয়ের আগে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পর দশ হাজার পাঁচ টাকা যৌতুক দিয়ে বরকে আশীর্বাদ করেছিলেন মহর্ষি।

বেলার বিয়ে হয়েছিল ১৯০১-এর ১৫ জুন। আর সেবছরই ৯ অগস্ট তিনদিনের ব্যবস্থাপনায় বিলেতযাত্রী সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে রেণুকার বিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ।

অতি কোমল স্বভাবের রেণুকার বয়েস তখন সাড়ে এগারো বছর। স্বামীর হঠাৎ খেয়ালে ঠিক করে আসা মেয়ের বিয়ের খবর জেনে অবাক হলেও বিয়েতে অমত করেননি মৃণালিনী। নিজের জীবদ্দশায় তাঁকে দেখে যেতে হয়নি এই দুই বিয়ের করুণ পরিণতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *