ছিল, আছে, তারা নেই! আবার হবে তো!

Slider জাতীয় টপ নিউজ সম্পাদকীয়

রিপন আনসারী: জীবনের অর্ধেক সময় সাংবাদিকতায় যাচ্ছে। একটু আগে আমার শ্রদ্ধেয় প্রতিথযশা সাংবাদিক দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর একটি লেখা তার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে পড়লাম। লেখাটির শিরোনাম হল “ কে মরি, কে বাঁচি জানি না”। লেখাটি পড়ে নিজেকে অসহায় করে ফেলতে বাধ্য হলাম। কারণ এত বড় মাপের একজন সাংবাদিকের লেখায় যে গভীর অনিশ্চিয়তা ও অসহায়ত্ব দেখলাম তাতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলোম। কিছুক্ষন কোন কথাই বলিনি। উনার লেখাটা হল, “কে মরি, কে বাঁচি জানি না। জানে শুধু উপরওয়ালা। তার হাতেই সবকিছু। চারদিক থেকে একের পর এক খারাপ খবর আসছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ কার্যত লকডাউন হয়ে গেছে। এটা একটি উত্তম ব্যবস্থা। আরো আগে হলে ভালো হতো। সবকিছু থেমে গেছে।অসুস্থ রাজনীতির লড়াইও নির্বাসনে। স্বাধীনতা দিবসও চলে গেল নিরবে। অফিস-আদালত বন্ধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। গণপরিবহনের চাকাও ঘুরছে না। বিমানবন্দরও ফাঁকা। ট্রেনের চাকাও থেমে গেছে। হোটেল-রেস্তরাঁ বন্ধ। যারা মেসে থাকেন অনুমান করুন তারা কীভাবে আছেন? ‘বুয়ারা’ নিজের তাগিদেই বাড়ি চলে গেছেন। আর বস্তি! তাদের তো সীমাহীন কষ্ট। আমাদের অতিথি রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মারাত্মক ঝুঁকিতে। ঢাকার কাঁচাবাজার খোলা। তবে সবাই সতর্ক। ওষুধের দোকান চালু রয়েছে। ঢাকার রাজপথের চেহারা এর আগে এমন কখনো দেখিনি। এমনকি কারফিউর সময়ও মানুষজন উঁকিঝুঁকি মারে। এখন সেটাও চোখে পড়ছে না। দু’-এক জায়গায় কিছু মানুষ হেঁটে কোথাও যাচ্ছে- এমন খবর পাচ্ছি। আমি নিজেই ১২ দিন বাড়িতে স্বেচ্ছাবন্দি। অফিসে যাই না। চ্যানেল আইতে যাওয়াও বন্ধ। তবে ঘরে বসে ভয়েস অব আমেরিকার জন্য রিপোর্ট তৈরি করি প্রতিদিন। দরোজায় এখন আর কেউ নক করে না। কাজের মানুষও আসে না। গাড়ির চালকও চলে গেছে আইসোলেশনে।

বাড়িতে বসে অনলাইন দেখি। কখনো চোখ রাখি টিভির পর্দায়। কিছুই ভালো লাগে না। স্ত্রীর সঙ্গে বসে কিছু সময় কাটাই। গল্প করি। বিলেতে অবস্থানরত ছেলের সঙ্গেও কথা বলি। সেও আইসোলেশনে। মাঝে-মধ্যে পুরনো দিনের বাংলা ছবি দেখি। মন্দ লাগে না। চিকিৎসকদের পরামর্শ- আমি নাকি ঝুঁকি গ্রুপে রয়েছি। সহকর্মীরা জান বাজি রেখে অফিস করেন। কাগজ বের হয়। কিন্তু বিক্রি হয় না। রাস্তায় হকার নেই। অর্ধেকেরও বেশি জেলা থেকে বার্তা পাঠিয়ে বলা হয়েছে কাগজ পাঠাবেন না। বৃহস্পতিবার শুনলাম, ঢাকা ছাড়া আর কোথাও কাগজ পাঠানোর তাগিদ নেই। ঢাকার অবস্থাও ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। একটা সময় হয়তো কাগজ বন্ধ করে দিতে হবে। কলকাতার বহুল প্রচারিত ‘বর্তমান’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা আসলে কোথায় আছি? ফেক নিউজের জ্বালায় অস্থির। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাই যেন বিশেষজ্ঞ। এতে অনেক সময় বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের কলকারখানা এখনো চালু। কিন্তু কারা যেন খবর রটিয়ে দিয়েছে কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বাস্তব অবস্থা, তা না হলেও ফেক নিউজ থামাবে কে? দু’-একজনকে গ্রেপ্তার করলেই তো ফেক নিউজ বন্ধ হবে না। দরকার জনসচেতনতা। দায়িত্বশীল আচরণ। আমার মতো লাখ লাখ মানুষ স্বেচ্ছাবন্দি। তাদের সময় কীভাবে কাটছে তা অনুমান করতে পারি। খেলা বন্ধ না হলে সময়টা ভালো কাটতো। বিশেষ করে ইউরোপের ফুটবল লীগগুলো চালু থাকলে কথাই ছিল না। ইতিহাসবিদরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যা হয়নি এখন তা হচ্ছে। দুনিয়া লকডাউন হলে খুশি হবেন কে? ডোনাল্ড ট্রাম্প! না, তার ঘুমও হারাম হয়ে গেছে। অবশ্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বড়াই করে বলছেন, রাশিয়া মুক্ত। মাত্র ১ জন মারা গেছে। এটা কি শতভাগ বিশ্বাসযোগ্য খবর? নাকি ফেক নিউজ। লন্ডন থেকে এক বন্ধু ফোন করে বললেন, এর কিছুটা সত্যতা আছে। রাশিয়া শুরু থেকেই অনেকটা লকডাউনে চলে গিয়েছিল। এ জন্য সুফল পেয়েছে। আফ্রিকার মাত্র ৭টি দেশ এখনো করোনা মুক্ত। তবে ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি ছিল- এটা কবুল করতেই হয়।

বিদেশ ফেরতদের আমরা যেভাবে গ্রহণ করেছি তা ছিল আত্মঘাতী। এখন আর কাউকে দোষারোপ করে কোনো লাভ নেই। বরং ভুল থেকে আমাদের কিছু শিখতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটা জাতীয় দুর্যোগ। এটা এককভাবে সরকারের পক্ষে মোকাবিলা করা কঠিন। তাই সবাইকে নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। এটা হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে। এতে থাকবেন সব দলের প্রতিনিধি। বিশেষজ্ঞদেরও রাখতে হবে এই টাস্কফোর্সে। কলুষিত রাজনীতি যেন আমাদেরকে অন্ধ না রাখে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের আগাম বার্তা আমলে না নিলে আমরা বড় ধরনের বিপদে পড়ে যেতে পারি। তারা তো বলছেন, কয়েক লাখ মানুষের প্রাণহানি হতে পারে। স্তিমিত হয়ে যেতে পারে কোটি মানুষের প্রাণশক্তি। অর্থনীতির অবস্থা সহজেই অনুমান করতে পারি। যদি বাস্তব অবস্থা দেশকে এবং বাইরের দুনিয়াকে না জানাই তাহলে সহমর্মিতা থেকেও আমরা বঞ্চিত হবো। তাই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন আর কোনো ভুল করা চলবে না।।।

পুরো লেখাটি কয়েকবার পড়েছি। বুঝতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার সীমিত জ্ঞানে এই লেখার মর্ম বুঝা অসম্ভব। তবে আমার কাছে মনে হয়, বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্র এখন অসুস্থ। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশও আজ একই দিকে ধাবিত। বাংলাদেশের ৫০তম জন্মদিন আমরা এই প্রথম পালন করতে পারিনি। পারিনি মুজিব বর্ষও পালন করতে। আজকে পুরো দেশ দৃশত অচল। থেমে গেছে সব চাকা। বিশ্ব মহামারী চলছে। বিশ্ব এই মহামারীর নিকট আত্মসমর্পন করেছে বলা চলে। কারণ এই রোগের ঔষুধ কেউ আবিস্কার করতে পারেনি এখনো। মানুষ মরছে, আক্রান্ত হচ্ছে। হু হু করে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই বিপদ সংকেত ভারী হচ্ছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ নিম্ম আয়ের। ঘরবন্ধি থেকে তারা না খেয়ে বিপদে পড়বে। সরকারই বা কি করবে। সাধ্যের বাইরে তো কিছু করতে পারবে না। সৃষ্টিকর্তার বিশেষ রহমতে যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তবে আমাদের কপালে ভয়াবহ বিপদ আসছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশ ও মানুষ অজানা পথে হাঁটতে থাকবে। কি হবে কেউ জানে না, জানেন একমাত্র সৃষ্টিকর্তা।

বাংলাদেশের মানুষ এই ধরণের পরিস্থিতির মোকাবেলা করেনি কখনো। তাই এই রকম পরিস্থিতিতে কি করণীয় তাও তারা জানেন না। যারা শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে গেছেন বা যাচ্ছেন তাদেরও গৃহবন্ধি হতে হবে এখন ঘোষণাও হল। এসবই মানুষকে নিরাপদ রাখার জন্য করছে সরকার। সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে। কিন্তু কি করে সম্ভব হবে! পরিস্থিতির যদি প্রাকৃতিকভাবে উন্নতি না হয়, তবে সরকারই বা কি করতে পারবে। তাই এখন আমরা ঘরে বসে যুদ্ধ করছি। সরকার আমাদের ঘরে রাখতে সশস্ত্র বাহিনীও মাঠে নামিয়েছে। বাইরে গেলে দন্ড দিচ্ছে। মানে ঘরে থাকার আদেশ। তাই আমরা ঘরেই আছি। কিন্তু ঘরে কতদিন থাকতে পারব, তা নিয়ে সংশয় তো আছেই। কারণ আমরা গরীব মানুষ। মাঠে ঘাটে ঘাম ঝরিয়ে বাঁচতে হয় আমাদের। আামাদের দেশে বড় লোকের সংখ্যা অনেক কম। যারা বড় লোক তারা তাদের সম্পদ মরে গেলেও কাউকে দিবে না। এই অভ্যাস আমাদের নেই বললেই চলে। তাই সরকার নিজ থেকে এত সম্পদ দিতে পারবে না, যে সম্পদক আমাদের বাঁচার জন্য লাগবে। তাই বিপদ হবেই।

বাংলাদেশের সকল মানুষ আজ একটি অনিশ্চিয়তার দিকে ধাবিত। যে রোগ এসেছে, সে রোগের কোন ঔষুধ নেই। বাংলাদেশ কেন বিশ্বেও নেই। তাই এই রোগের যারা চিকিৎসা করবে, জীবনের ভয়ে তারাও ভীত। অনেক চিকিৎসকও চিকিৎসা করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়ে গেছেন, কোন কোন দেশে মারাও গেছেন। সারা বিশ্বের করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, এমন কোন পেশা নেই যে পেশার মানুষ আক্রান্ত হয়নি।

মাতিউর রহমান চৌধুরীর লেখায় একটি বিশেষ দিক উঠে এসেছে। তা হল সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা হুমকির মুখে পড়েছে। পশ্চিমভঙ্গের একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকা দৈনিক বর্তমান বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের সিলেট জেলার পত্রিকাগুলোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গণপরিবহন, স্থল, জল ও বিমান পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পত্রিকা পাঠকের কাছে পৌছানোও অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে হয়ত, প্রিন্ট মিডিয়া চরম বিপদে পড়তে পারে। তবে দৈনিক পত্রিকা বিপদে পড়ার পিছনে ফেক নিউজ দায়ী। সেটা হল, কাগজে করোনা ভাইরাস থাকে। শুধু কাগজ নয় টাকাও করোনা ভাইরাস থাকে এমম গুজব ছড়িয়ে এক শ্রেনীর মানুষ দৈনিক পত্রিকাকে বিপদে ফেলে দিয়েছে। এ ধরণের গুজবী সংবাদ পরে অবশ্য মিথ্যা প্রমান হয়ে গেলেও গুজব কাজ করছে এখনো। গুজবের কারণে পত্রিকার হকাররাও এখন কাজ করতে চাইছে না। পত্রিকার পাঠকরাও পত্রিকা বিমুখ হচ্ছে।

এ ছাড়া রাষ্ট্রের সকল অঙ্গও অসুস্থ এখন। সকল অঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যমও আক্রান্ত। কারণ সংবাদকর্মীরা মাঠে কাজ করছেন চরম ঝুঁকি নিয়ে। সংবাদকর্মী সুরক্ষায় তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। তবুও এখনো কোন সংবাদকর্মী দায়িত্ব পালনে অনিহা প্রকাশ করেননি। এই দায়িত্বশীলতা ও দেশপ্রেম প্রতিটি সংবাদকর্মীকে গর্বিত করে। আমরা প্রত্যাশা করি, প্রতিটি পেশার লোক আমাদের মত জীবন মরণ মাথায় নিয়ে কাজ করছে, করবেও ইনশাল্লাহ। এই মরণব্যাধী রোগে শুরু আগে যারা ছিলেন, তারা এখন নেই। যারা আছেন তাদের মধ্যে হয়ত কেউ কেউ নাও থাকতে পারেন।

যদি জাতি থাকে, তবে হয়ত যারা থাকবেন, তারা ভাববেন, যারা ছিল, তারা এখন নেই। যারা থাকবেন তারা, যারা ছিলেন তাদের স্মৃতি স্বরণ করে নতুনভাবে বাঁচার চেষ্টা করবেন, এই ভেবে যে, আবার হবে তো!

পরিশেষে আশাবাদ ব্যক্ত করতে চাই, সৃষ্টির্তার বিশেষ ইচ্ছায় আমরা সহ সারা বিশ্ব এই বিপদ থেকে মুুক্ত হবে। আবার আমরা সবাই হাসিমুখে রাস্তায় নামতে পারব, এক সাথে জীবন যাপন করতে পারব। সেই আশায় পথ চেয়ে রইলাম। সৃষ্টিকর্তা সবার মঙ্গল করুন। আমিন।

প্রধান সম্পাদক
গ্রামবাংলানিউজ

তাং ২৬ মার্চ ২০২০

রাত ৮টা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *