একাত্তরের গেরিলা খোকার বিদায়

Slider জাতীয় টপ নিউজ


ঢাকা: সাদেক হোসেন খোকা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সামনে রঙিন ভবিষ্যতের হাতছানি। কিন্তু মাতৃভূমিকে ভালোবাসা এক তরুণের কাছে এসবই তুচ্ছ। সব ছেড়েছুড়ে চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর বিরুদ্ধে। ঢাকা শহরে গেরিলা যোদ্ধারা তখন পাকহানাদার বাহিনীর কাছে রীতিমতো আতঙ্ক । আর এই গেরিলা বাহিনীর একাধিক সফল অপারেশনে নেতৃত্ব দেন সাদেক হোসেন খোকা। তার মতো অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার অসীম ত্যাগ ও তিতীক্ষার বিনিময়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

সেই মাতৃভূমি বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সাদেক হোসেন খোকা। গতকাল বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টা ৫০ মিনিটের দিকে ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি…….রাজিউন)।

ক্যান্সারে আক্রান্ত সাদেক হোসেন খোকা পাঁচ বছর ধরে নিউ ইয়র্কেই অবস্থান করছিলেন। গত ১৮ই অক্টোবর থেকে ম্যানহাটনের মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে ভর্তি ছিলেন তিনি। ৬৭ বছর বয়স্ক বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী, অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র খোকার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন তার ছেলে ইশরাক হোসেন। খোকার মৃত্যুতে তার সহকর্মী, সহযোদ্ধাদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। রণাঙ্গনের সঙ্গীরা মাতম করছেন তার জন্য। তারা বলছেন, সাদেক হোসেন খোকা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। এই সত্য কেউ কোন দিন মুছে দিতে পারবে না। খোকার ইচ্ছা ছিল স্বদেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার। কিন্তু তিনি ও তার স্ত্রীর পাসপোর্ট ছিল না বছর তিনেক ধরে। বাংলাদেশ কনস্যুলেটে পাসপোর্ট চেয়ে আবেদন করেও সাড়া পাননি তারা। লাইফ সাপোর্টে যাওয়ার আগে খোকা পরিবারের সদস্যদের জানান, জুরাইনে বাবা-মায়ের কবরের পাশে শায়িত হতে চান তিনি। তবে পাসপোর্ট না মেলায় এ নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, খোকার দেশে ফেরার ক্ষেত্রে সব ধরনের সহায়তা করা হবে। নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল সাদিয়া ফয়জুন্নেসা মানবজমিনকে বলেছেন, সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুর ব্যাপারটি তার পরিবার অবহিত করেছে। তার মরদেহ দেশে ফেরানোর ক্ষেত্রে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

জনবান্ধব রাজনীতিবিদ সাদেক হোসেন খোকার জন্ম ১৯৫২ সালের ১২ই মে। ছাত্র জীবনে বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন। একপর্যায়ে বামপন্থি রাজনীতি ছেড়ে আসেন বিএনপিতে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাত দলীয় জোটের প্রধান ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ওই অন্দোলনে ঢাকা মহানগর সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্বে ছিলেন সাদেক হোসেন খোকা। এরশাদের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৯০ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকায় হিন্দু সমপ্রদায়ের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন খোকা। এসময় ওই এলাকার মানুষের মন জয় করে নেন তিনি। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসনে (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি) আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে চমক তৈরি করেন খোকা। এসময় জাতীয় রাজনীতিরও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন তিনি। নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে বিএনপি। মন্ত্রিসভায় তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালেও তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ২০০১ সালে তিনি মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ঢাকার আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হলেও একমাত্র খোকাই জয়ী হন। পরে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলনে প্রায় পাঁচ বছর একক নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতায় পরিণত হন। সেসময় ঢাকার রাজপথে রক্ত রঞ্জিত খোকার ছবি এখনও অনেকের চোখেই দৃশ্যমান।

সাদেক হোসেন খোকা পুরান ঢাকার গোপীবাগে তার পৈতৃক বাড়িতে থেকেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ও বিএনপির বিভিন্নপদে দায়িত্ব পালন করে। ছিলেন ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতৃত্বেও। শুধু রাজনীতিতে নন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে ১৯৭২ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নের দায়িত্ব নিয়ে ক্লাবকে তিন বছরের মধ্যে তৃতীয় থেকে প্রথম বিভাগে উন্নীত করেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা খোকা ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ও ফরাশগঞ্জ ক্লাবের গভর্নিংবডির চেয়ারম্যান ছিলেন। জনবান্ধব নেতা হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ছিল খোকার। পুরান ঢাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ খোকাকে তারা সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পাশে পেতেন। যখনই ডাক পড়েছে, তখনই তিনি ছুটে গেছেন পুরান ঢাকাবাসীর কাছে। এজন্য তিনি পেয়েছেন ঢাকাবাসীর বিপুল সমর্থন।

তবে রাজনীবিদ, মন্ত্রী, ক্রীড়া সংগঠক সব পরিচয় ছাপিয়ে সাদেক হোসেন খ্যাতিমান ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। মেয়র থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকার বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করেছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধারা কে কোন দল করে তা কখনও দেখেননি খোকা। একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ই ছিল সবচেয়ে বড়। একাত্তরের গেরিলা খোকার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অধ্যায় শেষ হয়ে গেলো। তবে তরুণ প্রজন্ম যেভাবে তার প্রতি শোক আর ভালোবাসা প্রকাশ করছেন এক মুক্তিযোদ্ধা আর রাজনীতিবিদের জন্য এটি এক বড় পাওয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *