ত্রিমুখী আন্দোলনে উত্তাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Slider জাতীয় ঢাকা সারাদেশ


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: ত্রিমুখী আন্দোলনে আবারো উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামকে অপসারণের দাবিতে দীর্ঘ দুই মাস ধরে চলা আন্দোলন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় আবারো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইটি প্রশাসনিক ভবনই অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ। ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। এ ছাড়াও ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন শাখা ছাত্রলীগ এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দাবি, ‘চলমান আন্দোলনে শিবিরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ আন্দোলনের মদদদাতা শিবির।’

বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) বৈরি আবহাওয়া উপেক্ষা করে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ও পুরনো প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কর্মসূচি চলাকালে ভবন দুটির কোনো ফটকেরই তালা খুলতে দেননি তারা। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাইরে অপেক্ষা করে ফিরে গেছেন। অফিস করতে আসেননি উপাচার্য। অবরোধের কারণে পূর্বনির্ধারিত শিক্ষকদের পদোন্নতি সংক্রান্ত তিনটি সভা (বোর্ড সিলেকশন) বাতিল করা হয়েছে; যা এটি নিয়ে তৃতীয় বারের মতো পেছানো হলো। কর্মসূচি চলাকালে প্রশাসনের কেউ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে কিংবা অফিস করতেও আসেননি। তবে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের ভর্তি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ (সনদপত্র উত্তোলন) সম্পন্ন করা হয়েছে কর্মকর্তাদের ডেকে এনে।

আন্দোলনকারীরা জানান, কাল বন্ধের দিন হওয়ায় তারা দাবি আদায়ে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করবেন। ২৬ অক্টোবর একই দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করা হবে। এছাড়া আগামী রবিবার আবারো প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে ‘দুর্নীতি ও অনিয়মের’ অভিযোগ তুলে দুই মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি, বাম ও আওয়ামীপন্থী (একাংশ) শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। নির্মিতব্য তিনটি হলের স্থান পুর্নবিবেচনাসহ দুটি দাবি মেনে নিলেও দুর্নীতির অভিযোগের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি মানছেন না উপাচার্য। এ কারণে গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে তার পদত্যাগ দাবি করে আসছিলেন আন্দোলনকারীরা। ‘সসম্মানে পদত্যাগের’ জন্য উপাচার্যকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন তারা। এর মধ্যে পদত্যাগ না করায় তাঁর অপসারণ দাবি করে আসছেন আন্দোলনকারীরা।

ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম অনিক কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা উপাচার্য অপসারণের দাবিতে বৃহস্পতিবার অবরোধ করেছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। আমরা এ উপাচার্যকে প্রত্যাখান করেছি।

আন্দোলনের সমন্বয়ক দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, আমরা আলটিমেটাম দিয়েছিলাম স্বেচ্ছায় পদত্যাগের জন্য। কিন্তু উপাচার্য পদত্যাগ করেননি। আমাদের এখনকার কর্মসূচি তাকে অপসারণের কর্মসূচি। এই ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার কর্মসূচি।

উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলম বলেন, তাদের অবরোধের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমার কথা হলো উনারা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। আমার মনে হয় তাদের উচিত ছিলো আচার্য এ বিষয়ে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার জন্য অপেক্ষা করা।

আন্দোলনে শিবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের অপসারণের দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশের চলমান আন্দোলনকে ঘিরে শিবির বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা করছে বলে দাবি করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। চলমান আন্দোলনে শিবিরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে দাবি করে তাঁরা বলেন, ‘এ আন্দোলনের মদদদাতা শিবির।’ গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় নতুন প্রশাসনিক ভবনের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, ২২ অক্টোবর আন্দোলনকারীদের মশাল মিছিল চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুই শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। তাদের একজনের মোবাইল থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং স্বীকারোক্তি থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে আন্দোলন সংগঠকগণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনকে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। যে আন্দোলন চলছে তার পেছনে মদদ দিচ্ছে শিবির, সেটিও স্পষ্ট হয়েছে। আন্দোলনকারীগণ এ বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা করছে।

শাখা ছাত্রলীগ ও কোটা সংস্কারের বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ

চার দফা দাবিতে জাহাঙ্গীরনরগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটায় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানার নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনার পদদেশে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। বিক্ষোভ মিছিলে শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন হল ইউনিটের প্রায় তিন শতাধিক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

তাদের দাবিগুলো হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অভিযোগে আটক ‘শিবির’ নেতাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করা, মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থের যোগানদাতাদের সনাক্ত করে রাষ্ট্রীয় আইনে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক একটি তদন্ত কমিটি গঠন এবং আটক শিবির নেতাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা সংহিস কর্মকাণ্ডে ঘটানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত ও রাষ্ট্রীয় আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ, সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও নাশকতা সৃষ্টির ‘অপচেষ্টায়’ লিপ্ত ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজনীতি আইন করে নিষিদ্ধ করা।

সমাবেশে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন, আমরা জেনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি একজন ‘শিবির কর্মী’কে আটক করে পুলিশে দিয়েছে। সে স্বীকার করেছে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। তারা যে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে চাইছে তার প্রমাণও নাকি তার কাছে পাওয়া গেছে।

মো. জুয়েল রানা আরো বলেন, আজকের বিক্ষোভ মিছিলের মধ্য দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর ছাত্রলীগ আওয়াজ দিচ্ছে জাবিতে কোনো মৌলবাদের জায়গা হবে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল ছাত্রের দাবির প্রেক্ষিতে শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তার মানে এই নয় যে তারা থেমে আছে। তারই ধারাবাহিকতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে তারা।

এদিকে জাবিতে উপাচার্য অপসারণের দাবিতে চলমান আন্দোলনে ‘শিবিরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, এ আন্দোলনের মদদদাতা শিবির’; প্রশাসনের এমন দাবিকে ‘ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যাচার ও গুজব’ আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ছাত্র অধিকার পরিষদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মীরা। বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে তারা এ বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু করেন। পরে মিছিলটি গুরুত্বপূর্ণ স্থপনা প্রদক্ষিণ করে পুরনো প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে শেষ হয়। এতে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ জাবি শাখার প্রায় অর্থ শতাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *