ঢাকা: অবশেষে যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ওমর ফারুক চৌধুরীকে। সেইসঙ্গে ২৩ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় সংগঠনের সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসের প্রস্তুতি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিতে সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য চয়ন ইসলামকে আহ্বায়ক এবং সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। একই সঙ্গে যুবলীগের নেতৃত্ব দেওয়ার বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৫৫ বছর।
গতকাল রোববার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুবলীগ নেতাদের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য, যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে ওমর ফারুক চৌধুরীসহ বিতর্কিত চার নেতার প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। ফলে তারা সেখানে ঢোকার সুযোগ পাননি। নিষেধাজ্ঞা পাওয়া অন্য তিন নেতা হলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এমপি এবং আতিউর রহমান দিপু।
বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেছেন। সংগঠনের আগামী জাতীয় কংগ্রেস নিয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি যুবলীগ নেতৃত্বের জন্য বয়সসীমা ৫৫ বছর নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, বৈঠকে ওমর ফারুক চৌধুরীকে যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ২৩ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠেয় সংগঠনের কংগ্রেস আয়োজনে একটি প্রস্তুতি কমিটিও করা হয়েছে। যেখানে চয়ন ইসলামকে আহ্বায়ক ও হারুনুর রশীদকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। আর সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সব সদস্য প্রস্তুতি কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন। এই প্রস্তুতি কমিটি আগামী জাতীয় কংগ্রেসের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নেবে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাদের সবাইকে অব্যাহতি দিতে নেত্রী (শেখ হাসিনা) নির্দেশ দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। যুবলীগ চেয়ারম্যানকে বহিস্কার করা হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি বলছি অব্যাহতি।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ওমর ফারুক চৌধুরীকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়নি। এখন থেকে কংগ্রেস প্রস্তুতি কমিটিই সংগঠনের সব কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, ফারুক হোসেন, অ্যাডভোকেট বেলাল হোসাইন, সুব্রত পাল, আমির হোসেন গাজীসহ বেশ কয়েকজন যুবলীগ নেতা বক্তব্য দেন। সংগঠনের চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন বিতর্কিত নেতার বিরুদ্ধে পদবাণিজ্য ও দুর্নীতি-অনিয়মসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ তুলে ধরেন তারা।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে আগেই জানাতে পারতে। তবে আমি কিন্তু সবই জানতাম। আমার আত্মীয় হোক আর যে-ই হোক, অপকর্ম করে কেউই কোনো ছাড় পাবেন না।’ তিনি আরও বলেন, কংগ্রেস প্রস্তুতি কমিটিতে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সব সদস্যই থাকবেন। তবে বিতর্কিত কোনো নেতা যেন এই কমিটিতে স্থান না পান, সেদিকে নজর রাখতে হবে।
এ সময় ৫৫ বছরের বেশি বয়সী নেতারা যুবলীগের নেতৃত্বের বয়সসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও কিছুটা ছাড় দেওয়ার অনুরোধ জানালে তা ভেবে দেখার আশ্বাস দেন শেখ হাসিনা। এক নেতার বক্তব্যের জবাবে তিনি জানান, শিগগির ফরিদপুরকে বিভাগ ঘোষণা করা হবে। ‘পদ্মা’ নামে ওই বিভাগ গঠিত হবে।
বৈঠকে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা ছাড়াও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপসহ দলের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন।
চলমান ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকালে নানা বিতর্কের মুখে থাকা ওমর ফারুককে যুবলীগের চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার শেষ পরিণতি নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অবসান হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকেই পদবাণিজ্য ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অভিযুক্ত ওমর ফারুক চৌধুরী সমালোচনার মুখে পড়েন। প্রভাবশালী এই যুবলীগ নেতার ব্যাংক হিসাব তলব করার পাশাপাশি তার বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়। এর পর থেকে ওমর ফারুক চৌধুরী অনেকটাই লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। কয়েক সপ্তাহ ধরে আসছিলেন না সংগঠনের কার্যালয়েও।
এর আগে গত ১১ অক্টোবর যুবলীগ চেয়ারম্যানকে ছাড়াই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক করেছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্যরা। সেখানে ওমর ফারুক চৌধুরীর ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান আনিসকে বহিস্কার করা হয়। একই সঙ্গে প্রেসিডিয়ামের অনেক সদস্য সংগঠনের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে পদবাণিজ্যসহ ক্যাসিনো, দরপত্র ও চাঁদাবাজির কমিশন পেয়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার অভিযোগ তুলে ধরেন। এই অবস্থায় কাউকে ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ করার দাবিও ওঠে ওই বৈঠকে।
ওমর ফারুক চৌধুরী ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত যুবলীগের পঞ্চম কংগ্রেসে সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। পরে তৎকালীন চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয় ওমর ফারুক চৌধুরীকে। ২০১২ সালের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কংগ্রেসে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান তিনি। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পর ২০১৫ সালে পরবর্তী কংগ্রেস হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। মূলত সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের অনীহার কারণেই নির্ধারিত সময়ের পরও কংগ্রেস করা যায়নি বলে অভিযোগ যুবলীগ নেতাদের। তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে সর্বশেষ কংগ্রেসের সাত বছর পর ২৩ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
চার নেতাকে ডাকা হয়নি :গণভবনের বৈঠকে যোগ দিতে যুবলীগ থেকে যে তালিকা পাঠানো হয়েছিল সেখানে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সবার নামই ছিল। তবে গণভবন থেকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এমপি বিতর্কিত হওয়ায় বৈঠকে থাকতে পারবেন না। গতকাল নতুন করে প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুর রহমান মারুফ এবং আতিউর রহমান দিপুও গণভবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ হন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ গতকাল রাতে সমকালকে বলেছেন, কে বৈঠকে থাকবেন কিংবা থাকবেন না- সেটি সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রী ও গণভবনের সিদ্ধান্তের বিষয়।
সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, নানা অপকর্মসহ বিতর্কিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় ওই চার নেতাকে বৈঠকে ডাকা হয়নি। অর্থাৎ এই চার নেতা গণভবনে নিষিদ্ধ হয়েছেন। তারা আগামীতে যুবলীগের কোনো কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে পারবেন না। সংগঠনের জাতীয় কংগ্রেসেও তাদের সম্পৃক্ততা থাকবে না।
ভাগ্যবান নেতারা :প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গতকালের বৈঠকে উপস্থিত নেতারা নিজেদের ভাগ্যবান হিসেবে দেখছেন। তাদের দৃষ্টিতে, অতীতে আর কখনোই সংগঠনের কংগ্রেসের আগে এ ধরনের বৈঠক হয়নি। কিছু নেতার বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে বৈঠকটি হয়েছে। অথচ এর আগে দফায় দফায় অনুরোধ করার পরও সংগঠনের চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদক এমন বৈঠক আয়োজনের উদ্যোগ নেননি। এ কারণে গতকালের বৈঠকে উপস্থিত নেতারা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছেন।
গতকালের বৈঠকে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য চয়ন ইসলাম, অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান শহিদ সেরনিয়াবাত, মজিবুর রহমান চৌধুরী, ফারুক হোসেন, শেখ শামসুল আবেদীন, ড. আহমদ আল কবির, আলতাফ হোসেন বাচ্চু, জাহাঙ্গীর কবির রানা, সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, মাহাবুবুর রহমান হিরন, আব্দুস সাত্তার মাসুদ, আতাউর রহমান, অ্যাডভোকেট বেলাল হোসাইন, আবুল বাশার, মোহাম্মদ আলী খোকন, অধ্যাপক এ বি এম আমজাদ হোসেন, শাহজাহান ভূঁইয়া মাখন, ইঞ্জিনিয়ার নিখিল গুহ, অ্যাডভোকেট মোতাহার হোসেন সাজু, ডা. মোখলেছুজ্জামান হিরু, সৈয়দ মাহামুদুল হক, যুগ্ম সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ মহি, সুব্রত পাল, সাংগঠনিক সম্পাদক সালাউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ, আমির হোসেন গাজী, বদিউল আলম, ফজলুল হক আতিক, আবু আহমেদ নাসিম পাভেল, আসাদুল হক, ফারুক হাসান তুহিন, এমরান হোসেন খান ও আজহার উদ্দিন। তবে তালিকায় নাম থাকলেও দেশের বাইরে কিংবা ঢাকার বাইরে থাকায় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুর আলম শাহীন, অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ ও নাসরিন জাহান চৌধুরী শেফালীসহ কয়েকজন নেতা বৈঠকে যোগ দিতে পারেননি।