সিসি ক্যামেরা ঘেরা এসি নৌকায় বসবাস ইউনিয়ন যুবলীগ নেতার!

Slider গ্রাম বাংলা বাংলার মুখোমুখি

ঢাকা:নাম তার লুৎফর রহমান। এ নামে তিনি এলাকায় তেমন পরিচিত নন। তার পরিচয় ‘পাগলা ডাকাত’ নামে। পাগলা ডাকাত বললেই এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই এক নামেই চেনেন।

তিনি জমিনে থাকেন না। থাকেন নদীর ওপর ভাসমান নৌকায়। তাও যেমন তেমন নৌকা নয়। থাইগ্লাস লাগানো এয়ারকন্ডিশন্ড (এসি) নৌকায়। টিভি-ফ্রিজ তো আছেই। সৌরবিদ্যুতে চলে এসব। আছে সিসি ক্যামেরাও।

বয়স আনুমানিক চল্লিশ বছর। চরবাসীর কাছে তিনি এক মূর্তিমান আতঙ্ক। এক সময় নিজে চুরি-ডাকাতি করতেন। এখন সর্দার হয়ে গড়ে তুলেছেন পাগলা বাহিনী। এসব অপরাধ করেই কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকার মালিক তিনি।

খুন, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক, অস্ত্র, লুটপাটসহ একাধিক মামলা ঝুলছে তার মাথার ওপর। ওয়ারেন্টও আছে একাধিক মামলার। তবুও দোর্দণ্ড প্রতাপেই চলাফেরা করছেন। তার দলীয় পরিচয়ও আছে। তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। তিনি এখন চরের রাজা। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চমকপ্রদ এসব তথ্য মেলে।

বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর চর চালুয়াবাড়ী ইউনিয়নের পূর্বপাড়ের বহুলাডাঙ্গা গ্রামের মুছা শেখ ওরফে দালাল মুছার ছেলে এই লুৎফর রহমান ওরফে পাগলা ডাকাত। তার ইউনিয়নের পাশের ইউনিয়ন জামালপুরের মাদারগঞ্জ ও ইসলামপুর এবং আরেকপাশে গাইবান্ধার সাঘাটার জুমারবাড়ী এলাকা। তিন জেলার সীমান্ত এলাকার মধ্যে পড়েছে বহুলাডাঙ্গা গ্রাম। তাই তার চলাফেরা এবং কর্মকাণ্ড তিন জেলার ওই এলাকাগুলোতেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর মধ্যে আছে কৃষকের জমির ফসল লুট, যমুনায় গরু কিংবা যে কোনো মালপত্র বোঝাই নৌকায় ডাকাতি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা, জুয়ার আসর বসানো, যাত্রার নামে দেহব্যবসা, বিরোধপূর্ণ জমি নিজের নামে লিখে নেওয়া, ডাকাতিতে বাধা দিলেই খুন, অপরাধী ও পলাতক আসামিদের আশ্রয় দেওয়া ও প্রহসনমূলক সালিশ করা। তার বাহিনীতে বিভিন্ন জেলার শতাধিক সদস্য রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার আছে ২০০ গরু ও ৩০০ মহিষের বিশাল খামার। এগুলো চরে বিশাল এলাকাজুড়ে বিচরণ করে। অভিযোগ আছে, তার খামারের গরু-মহিষের বেশিরভাগই লুট করা। নীলফামারী জেলা সদরের রামগঞ্জ এলাকায় চার বছর আগে একটি দ্বিতল বাড়ি কিনেছেন। ওই বাড়ির বাজার মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। বগুড়া জেলার সোনাতলা উপজেলার তেকানী-চুকাইনগর এলাকার তালতলায় ৩ বছর আগে তার স্ত্রী বুলবুলি খাতুনের নামে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। এর বাজার মূল্য প্রায় অর্ধকোটি টাকা। এছাড়া শতাধিক বিঘা জমি ও অর্ধশত পুকুরের মালিক তিনি। তিন সন্তানের জনক লুৎফর ছেলেদের নামেও ব্যাংকে প্রায় কোটি টাকা আমানত রেখেছেন বলেও অভিযোগ আছে। ‘পাগলা হাট’ নামে এলাকায় একটি হাটও করেছেন। তার ৬টি নৌকা ডাকাতির কাজেই বেশি ব্যবহার হয়। একটিতে তিনি বাস করেন। তিনি যে নৌকায় বসবাস করেন সেটির দৈর্ঘ্য ৬০ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট। তার দৃশ্যমান অর্থ-সম্পদের চেয়ে অদৃশ্য অর্থ-সম্পদই বেশি বলে অভিযোগ আছে।

লুৎফরের বিরুদ্ধে সারিয়াকান্দি থানায় ৬টি, সোনাতলা থানায় ৩টি, জামালপুরের ইসলামপুর থানায় ৩টি ও গাইবান্ধার সাঘাটা থানায় ২টি এবং জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানায় ২টি মামলার খবর পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে ৫টি মামলার। অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য কেউ থানায় যাচ্ছে টের পেলেই ওই পরিবারকে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। কেউ কেউ তার ভয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

লুৎফর রহমান ওরফে পাগলা ডাকাত আগে বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রায় আট বছর আগে যুবলীগে যোগ দেন। পাঁচ বছর আগে যুবলীগের ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি হন পেশিশক্তির বলে। এখনও তিনি যুবলীগের সভাপতি হিসেবেই আছেন। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন চেয়ে পাননি। তার জেঠাতো ভাই আশরাফ শেখ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে আছেন। পাগলা ডাকাতের বিরুদ্ধে দলীয় কিংবা মামলা মোকদ্দমা হলেই আশরাফ শেখ তার পক্ষে তদবির করেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

তবে আশরাফ শেখ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, লুৎফরের বিরুদ্ধে এলাকার প্রতিপক্ষ মিথ্যা অপবাদ ছড়াচ্ছে। সে আগে ‘দুষ্টুমি’ করলেও এখন ভালো হয়ে গেছে বলে দাবি করেন তিনি।

স্থানীয়রা কেউ তার বিরুদ্ধে আতঙ্কে মুখ খুলতে চান না। তবে কিছু লোক প্রতিবাদও করছেন। তাদের মধ্যে একজন আব্দুল হান্নান। তিনি গত ১৪ অক্টোবর বগুড়া প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে লুৎফর রহমান ওরফে পাগলা ডাকাতের অপকর্ম তুলে ধরে তাকে গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানান। তবে তিনি পাগলার হুমকিতে এখন আর এলাকায় যেতে পারছেন না। তিনি বর্তমানে জয়পুরহাটে অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, প্রাণহানির আশঙ্কা সত্ত্বেও আমি প্রতিবাদ করছি। কারণ সে আমাদের পরিবারকে নিঃস্ব করেছে। আমরা এখন পথের ভিখারি। আমাদের মতো শত শত পরিবার পাগলা ডাকাতের ভয়ে এলাকা ছেড়েছে।

স্থানীয় চালুয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী বলেন, লুৎফরের খবর সবাই জানে কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। ওই এলাকার ইউপি মেম্বার জাহিদুল ইসলাম, রেজাউল করিমসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, পাগলা ডাকাতের অত্যাচারে আমরা এলাকায় টিকতে পারছি না। প্রতিনিয়ত সে লুটপাট, ডাকাতি ও মাদকের ব্যবসা করে এলাকায় রামরাজত্ব কায়েম করেছে। তাকে দ্রুত গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানান তারা।

সারিয়াকান্দি উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিক মাহমুদ বলেন, লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, জেলার নির্দেশ পেলেই তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।

জেলা যুবলীগের সভাপতি শুভাশিস পোদ্দার লিটন বলেন, লুৎফরের বিষয়ে আমার জানা ছিল না, আমি সম্প্রতি জানতে পেরে লুৎফর রহমানকে বহিস্কার করে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে সারিয়াকান্দি যুবলীগ নেতাদের নির্দেশ দিয়েছি।

লুৎফর রহমান ওরফে পাগলা ডাকাতের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে প্রথমে কিছুটা ভড়কে গেলেও পরে স্বাভাবিক হয়ে তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সামনে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। আমি এবার নির্বাচনে দাঁড়াব, প্রতিপক্ষ আমাকে নির্বাচনে পরাজিত করতে ও দলীয় মনোনয়ন যাতে না পাই, সে জন্য নানা অপবাদ ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, তার খামারে নিজের টাকায় কেনা ১০০ গরু ও ২০০ মহিষ আছে। সোনাতলায় তার বাড়ির মূল্য ২০ লাখ ও নীলফামারীর বাড়ির মূল্য ৩০ লাখের বেশি হবে না। তার নৌকার বিষয়ে বলেন, নদী এলাকায় বসবাস করতে গেলে নৌকা ছাড়া চলে না। আমি শখ করে একটি নৌকা বানিয়েছি।

সারিয়াকান্দি থানার ওসি আল আমিন জানান, তাকে গ্রেফতারে স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল মান্নানও নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। ওসি বলেন, লুৎফর যে স্থানে থাকেন সেটি তিন জেলার সীমান্তবর্তী। অভিযানের খবর পেলেই হয় জামালপুর, নয়তো গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সে আত্মগোপন করে। তিন জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে অভিযান চালালে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *