ঢাকা: ‘স্যার, ধরা যখন পড়েছি, তখন আর চুপ থেকে ফায়দা কী। আমি সব বলব। কিন্তু আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার কইরেন না। আমি একাই দোষী নই। সম্রাট ছাড়া কিভাবে ক্যাসিনো ব্যবসা হয়? কাউসার ও সাঈদও আমার সহযোগী। জি কে শামীমও এই কারবারে জড়িত। ক্যাসিনো মানে জুয়া খেলা। এখানে কাঁচা টাকা। শত শত কোটি টাকার খেলা। কাঁচা টাকা পেলে তহন সবাই হাত পাইতা দেয়। এই টাকার ভাগ পুলিশকে দিছি। পুলিশের বড় বড় স্যাররা নিছে। আমি যুবলীগের নেতা ছিলাম। সবার সঙ্গেই আমার সম্পর্ক ছিল। তাঁদের ধরেন। দেখবেন দেশে আর কেউ ক্যাসিনো কারবার করতে পারবে না…।’
গ্রেপ্তারের পর জেরার মুখে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গড়গড় করে গোয়েন্দা পুলিশকে বলেছেন এই কথা। খালেদের এই স্বীকারোক্তিতে বিব্রতবোধ করছেন জিজ্ঞাসাবাদকারী গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদকারী সূত্র এই তথ্য জানিয়ে বলেছে, এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে খালেদের তথ্যে ফেঁসে যেতে পারেন পুলিশ সদর দপ্তর ও মহানগর সদর দপ্তরের সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে অনেক শীর্ষ কর্তা; মহানগরের মতিঝিল, রমনা, তেজগাঁও, মিরপুর, গুলশান ও উত্তরা বিভাগের অনেক পুলিশ কর্মকর্তাও। জিজ্ঞাসাবাদকারী সূত্র বলছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকেই ক্যাসিনো কারবারের ‘গডফাদার’ দাবি করেছেন খালেদ। এর বাইরে যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাসহ ঢাকা সিটি করপোরেশনের অনেকের নাম বলেছেন খালেদ।
জানা গেছে, খালেদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য মামলার তদারক কর্মকর্তার কাছে জানতে পেরে বিব্রত হয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। পরিস্থিতি সামাল দিতে গতকাল শনিবার বিকেলে অপরাধবিষয়ক বিশেষ সভা ডাকেন তিনি। এই বৈঠকে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিভিন্ন বিভাগের ডিসি ও থানার ওসিরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে রাজধানীতে আর কোনো ক্যাসিনো কারবার যাতে না চলতে পারে সে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে ক্যাসিনো কারবারিদের কাছ থেকে যেসব পুলিশ সুবিধা নিয়েছেন তাঁদের বিষয়ে কার কাছে কী ধরনের তথ্য আছে তা জানতে চাওয়া হয়েছে বলে বৈঠকে উপস্থিত এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, ডিএমপি কমিশনার বৈঠকে বলেছেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকে রাজধানীতে ক্যাসিনো কারবার চলেছে। তবে এখন থেকে ঢাকাতে কোনো ক্যাসিনো কারবার বা জুয়ার আসর চলবে না।
জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেসব মামলা দায়ের করা হয়েছে তার তদন্ত করা হচ্ছে। রাজধানীর ক্যাসিনোগুলো চলার সময় পুলিশের কোনো সহযোগিতা ছিল কি না তা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যদি কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
২০ জনের গ্রুপ খালেদের : খালেদের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত অন্তত ২০ জনের নাম পেয়েছে ডিবি। এরই মধ্য তাঁরা গাঢাকা দিয়েছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্যাসিনো কারবারে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে অন্তত ২০ জন ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন গোড়ান এলাকার কাউন্সিলর আনিসুর রহমান, যুবলীগ দক্ষিণের সদস্য খায়রুল, উজ্জল রাজু, রইসসহ আরো অনেকে। এঁরা তাঁকে মতিঝিলের শাহজাহানপুর এলাকায় চাঁদাবাজির পাশাপাশি টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করতেন।’
ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘খালেদের তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেছি। কিন্তু তাঁদের কেউই এলাকায় নেই।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদকে তিন দিনের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাটই ক্যাসিনোর আসল রূপকার। তাঁর হাত ধরেই ঢাকার মতিঝিল থানার বিভিন্ন এলাকার স্পোর্টস ক্লাবগুলোয় ‘হাউজি’ আসরকে ক্যাসিনোতে উন্নীত করা হয়। এ কাজে সম্রাটের সহযোগী হিসেবে পরিচিতি পান খালেদ। তাঁর দেওয়া তথ্য মতে, এসব ক্লাবের ক্যাসিনোতে খেলা এবং সেগুলো পরিচালনায় যুক্ত হন আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতাও। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মোমিনুল হক সাঈদ।
খালেদ জিজ্ঞাসাবাদে জানান, সম্রাটের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে ঢাকা মহানগরীর দক্ষিণের যুবলীগ সহসভাপতি আরমান, মতিঝিল এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইদ, সহসভাপতি সোহরাব হোসেন স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী সরোয়ার হোসেন বাবু, সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল, সাংগঠনিক সম্পাদক মাকসুদ, সহসভাপতি মুরসালিন, মনির হোসেন, মনা, রানা, শফি মনির হোসেন তার ক্যাসিনো কারবারসহ টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন।
খালেদ আরো জানিয়েছেন, রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকায় কমপক্ষে ১৭টি ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। এর মধ্যে ১৬টি ক্লাব নিজের লোকজন দিয়ে আর ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবটি সরাসরি তিনি পরিচালনা করতেন। বাকিগুলো সম্রাটের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
ক্যাসিনোর টাকা বিদেশে কিভাবে পাঠানো হতো সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ বলেছেন, সম্রাট গত কয়েক বছরে ক্যাসিনো কারবার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে নেপাল থেকে এক্সপার্ট এনেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১১ জন ঢাকার ক্যাসিনো কারবার নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করতেন। সম্রাট সিঙ্গাপুর গিয়ে ক্যাসিনোয় জুয়া খেলায় অংশ নিতেন। সে সময় তিনি দেশের অনেক টাকা পাচার করেছেন।
খালেদ জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, মগবাজার টিঅ্যান্ডটি কলোনির সন্ত্রাসী নাজির আরমান নাদিম ও শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে তাঁর ও সম্রাটের একসময় সুসম্পর্ক ছিল। চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনোর টাকা ওমানের মাসকটে থাকা সন্ত্রাসী নাদিমের কাছে পাঠাতেন তাঁরা। সেখান থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানও ভাগ পেতেন। জিসান বর্তমানে ভারতের পাসপোর্ট নিয়ে দুবাইয়ে বাস করছেন। জিসানের সঙ্গে জি কে শামীমেরও সম্পর্ক ছিল। তবে একপর্যায়ে জিসানের সঙ্গে তাঁর ও সম্রাটের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। আর এর জন্য জি কে শামীম দায়ী। কারণ জি কে শামীম তাঁর টেন্ডার কারবার নিয়ন্ত্রণে একসময় জিসানকে হাত করেন। খালেদ জানিয়েছেন, ২০১৬ সাল থেকে ঢাকায় তাঁরা ক্যাসিনো কালচার শুরু করেন।
উল্লেখ্য, গত বুধবার সন্ধ্যায় গুলশানের নিজ বাসা থেকে খালেদকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ওই সময় তাঁর বাসা থেকে ২০১৭ সালের পর নবায়ন না করা একটি শটগান ও ৫৮৫ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার তাঁকে গুলশান থানায় নেয় র্যাব। তাঁর বিরুদ্ধে এই থানায় অস্ত্র, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে চারটি মামলা দায়ের করেন র্যাব-৩-এর ওয়ারেন্ট অফিসার গোলাম মোস্তফা। এরপর রাতেই খালেদকে আদালতে উপস্থাপন করলে অস্ত্র মামলায় চার দিন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা দুটি মামলায় সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। পরে রাতেই মামলা দুটি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি, উত্তর) হস্তান্তর করা হয়। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। গতকাল শনিবার ছিল রিমান্ডের তৃতীয় দিন।