ডাকসুতে রাব্বানীসহ ৮ নেতা ঝুঁকিতে

Slider জাতীয় শিক্ষা


ঢাকা: মাদক সম্পৃক্ততা, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ইতিমধ্যেই নিজ সংগঠন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন গোলাম রাব্বানী। নৈতিক স্খলনজনিত কারণে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) সাধারণ সম্পাদক পদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিনেট থেকেও তাঁকে অপসারণ করার দাবি উঠেছে। ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ দাবি তুলেছেন। শিক্ষকদেরও মত হচ্ছে—অস্বচ্ছ বা অনৈতিক কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদলে রাখা উচিত নয়। ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একটি অংশেরও একই মত। ব্যবস্থা না নিলে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ছাত্র নেতৃত্ব নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠবে বলে মনে করছে তারা।

একই সঙ্গে ‘জালিয়াতি’ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ডাকসুর নেতা নির্বাচিত হওয়া সাতজনকে অপসারণ করার দাবিও তুলছেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি তাঁদের ভর্তির সুযোগ করে দেওয়ায় বাণিজ্য অনুষদের ডিন ড. শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের পদত্যাগও চান তাঁরা।

প্রসঙ্গত, রাব্বানীর সঙ্গে একই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি পদ থেকে অপসারিত হওয়া রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানিয়ে উপাচার্য বরাবর চিঠি দিয়েছেন।

ডাকসু থেকে রাব্বানীর পদত্যাগ বা অপসারণ দাবি

শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা বলছেন, নৈতিক স্খলনের দায়ে নিজ সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হলে কারো নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের ফোরামের কোনো পদে থাকা উচিত নয়। রাব্বানী ডাকসুর জিএস পদে বহাল থাকলে তাঁর ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে। মনের দুর্বলতা থেকে তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারবেন না, আবার শিক্ষার্থীরাও তাঁকে ছাত্রনেতা হিসেবে ভালোভাবে গ্রহণ করবেন না। এ ব্যাপারে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মতামত কিংবা ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন তাঁরা।

দীর্ঘ ২৮ বছর পর চলতি বছরের মার্চে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্রসংগঠনের পাশাপাশি ক্যাম্পাস ছাড়া ছাত্রদল ও অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র প্রতিনিধি পান শিক্ষার্থীরা। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিনেটে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হন।

ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে শোভন সহসভাপতি (ভিপি) পদে হারলেও সিনেট সদস্য হন। আর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী জিএস নির্বাচিত হন, সিনেটেও তিনি সদস্য হন।

ডাকসুর গঠনতন্ত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধির নৈতিক স্খলন ঘটলে, অনিয়ম কিংবা অপরাধমূলক কোনো কাজে জড়ালে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে সে বিষয়ে কিছু বলা নেই। তবে উপাচার্যকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া আছে, তিনি চাইলে যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

ডাকসু সভাপতি তথা উপাচার্যই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি যা মনে করবেন, সে ব্যবস্থাই নিতে পারবেন। গঠনতন্ত্রের ৫ ধারায় ডাকসু সভাপতি, কোষাধ্যক্ষ ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজের বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। এই ধারার (এ) উপধারায় বলা হয়েছে—ডাকসুর সভাপতি হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় নির্বাহী কমিটি, অন্যান্য কমিটি বা উপকমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। জরুরি পরিস্থিতি কিংবা যেকোনো অচলাবস্থায় ছাত্রসংসদকে সক্রিয় করতে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন তিনি। সংসদের সর্বোত্তম স্বার্থে তিনি যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, নির্বাহী কমিটি ভেঙে দিতে পারবেন এবং সংসদকে সাময়িক বহিষ্কার করতেও পারবেন।

গঠনতন্ত্রের ১৮ নম্বর ধারায় কোনো বিষয়, যা গঠনতন্ত্রে নেই সে বিষয়েও ডাকসুর সভাপতি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন আর সেই সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।

ছাত্রসংগঠনের নেতারা বলছেন, গঠনতন্ত্রে যেকোনো বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে উপাচার্যকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তিনি চাইলেই নৈতিক স্খলনের দায়ে ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন। ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর ইতিমধ্যেই তাঁর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে উপাচার্যকে অনুরোধ জানিয়েছেন। ভিপি নুর অনিয়ম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ৩৪ শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব বাতিল এবং তাঁদের মধ্যে ডাকসুতে নির্বাচিত সাত নেতার অপসারণের দাবি জানিয়েছেন গত রবিবার। তিনি গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তাঁর (গোলাম রাব্বানী) নৈতিক স্খলন প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে নিজ সংগঠন থেকে সরানো হয়েছে। যে স্খলনের কারণে নিজ সংগঠনেই তাঁর স্থান হয়নি, সেখানে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধির ফোরামে তাঁর থাকাটা সমীচীন নয়। সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনৈতিক ছাত্র নেতৃত্ব সাধারণ শিক্ষার্থীরা মেনে নেবেন না।’

নুর বলেন, ‘ব্যক্তিত্ববোধের জায়গা থেকে তাঁর নিজেরই পদত্যাগ করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এখনো করেননি। ডাকসুর সভাপতি অর্থাৎ উপাচার্যকে মৌখিকভাবে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তিনি বিষয়টি ভেবেচিন্তে দেখবেন বলে জানিয়েছেন। ডাকসুর সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি কোনো ব্যবস্থা না নিলে রাব্বানীর বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় ছাত্রসংগঠনগুলো মিলে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

গতকাল সোমবার বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট রাব্বানীর অপসারণ ও ডাকসুর নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির এক নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যিনি নিজ ছাত্রসংগঠন থেকে অপসারিত হন, তিনি নির্বাচিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে থাকতে পারেন না। এতে শিক্ষার্থী এবং ওই নেতার জন্যই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ শিক্ষার্থীরা তাঁকে ভালোভাবে গ্রহণ করবেন না আবার তিনিও শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো কাজ করতে পারবেন না। শিক্ষার্থীদের চাওয়ার দিকটি প্রাধান্য দিয়ে গঠনতন্ত্র অনুযায়ীই ব্যবস্থা নিতে হবে। অথবা নিজের নৈতিক অবস্থান থেকে নিজেই পদত্যাগ করতে পারেন, এটাই ভালো সমাধান হবে।’

ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেহেদী হাসান নোবেল বলেন, ‘দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে নিজ সংগঠন থেকে অব্যাহতি পাওয়া কোনো ব্যক্তি ডাকসুর পদে থাকতে পারেন না। বর্তমান বাস্তবতায় ডাকসুর অতীত ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে অবিলম্বে তাঁকে অপসারণ করতে হবে। এই ডাকসু অবৈধ ঘোষণা করে পুনর্নির্বাচন দিতে হবে।’

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাহুল রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একজন নৈতিক স্খলিত নেতা যিনি নিজের সংগঠন থেকেই বহিষ্কৃত, তিনি কিভাবে ডাকসুতে থাকবেন? তাঁর থাকা উচিত নয়। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বচ্ছ ইমেজের নেতৃত্ব চাই। ভর্তিতে যাঁরা জালিয়াতি করেন তাঁদেরও বহিষ্কার করতে হবে।’

সাত ডাকসু নেতার অপসারণ দাবি : অনিয়ম করে ভর্তি হওয়া ডাকসুর সাত নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ছাত্রলীগের ক্ষমতা প্রদর্শন করে, পরীক্ষা ছাড়াই জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রেখেছেন তাঁরা। যা আইন সিদ্ধ নয়, কাজেই তাঁদের ভর্তি বাতিলের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম ডাকসু থেকেও অপসারণ করতে হবে। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনগুলো বিক্ষোভ সমাবেশ করে তিন দফা দাবি জানিয়েছে।

বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে যাঁরা দুর্নীতি ও জালিয়াতি করেছেন, তাঁরা ছাত্র প্রতিনিধি হতে পারেন না। তাঁদের ডাকসু থেকে অপসারণ করতে হবে। ডাকসুতে অনৈতিক চরিত্রের কোনো নেতার স্থান হতে পারে না। এ নিয়ে আমরা আন্দোলনও করছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলা হয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অতিদ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।’

পরীক্ষা ছাড়া ভর্তি হওয়া ওই সাত নেতা হলেন—ডাকসু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আরিফ ইবনে আলী, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী, ক্রীড়া সম্পাদক শাকিল আহমেদ শাকিল, সদস্য নজরুল ইসলাম, মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান, রাকিবুল হাসান রাকিব ও নিপু ইসলাম তন্বী।

সিনেট থেকে শোভনের পদত্যাগ : ডাকসু নির্বাচনে হারলেও ছাত্রপ্রতিনিধি হিসেবে সিনেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ছাত্রলীগের সদ্য বিদায়ী সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন। অনিয়ম ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগ থেকে অপসারিত হওয়ার পর গতকাল সোমবার ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি উপাচার্য বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তাঁর পক্ষে পদত্যাগপত্র জমা দেন ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক আহসান হাবিব ও ডাকসু সদস্য রফিকুল ইসলাম সবুজ।

পদত্যাগপত্রে শোভন লিখেছেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি। বর্তমানে ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় আমি উক্ত পদ থেকে পদত্যাগ করতে আগ্রহী।’

প্রসঙ্গত, শোভন ও রাব্বানীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদক সম্পৃক্ততা ও আরো কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠায় গত শনিবার ছাত্রলীগের অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় তাঁদের অপসারণ করে আল নাহিয়ান খান জয়কে সভাপতি ও লেখক ভট্টাচার্যকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *