পরীক্ষা ছাড়া ভর্তির নিয়মের কথা জানালেন ডিন, অন্যদের দ্বিমত

Slider টপ নিউজ ঢাকা


ঢাকা: কোনো ধরনের লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলোতে ভর্তির সুযোগ রয়েছে বলে দাবি করেছেন অনুষদের ডিন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। তাঁর ভাষ্য, এই সুযোগটি পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করা শিক্ষার্থীরা। তাদের কেবল মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এমনকি এই ভর্তির জন্য কোনো সার্কুলারেরও প্রয়োজন হয় না।

মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের হাবিবুল্লাহ বাহার সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে ভর্তির এই ‘অদ্ভুত’ নিয়মের কথা জানিয়েছেন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। ডিন সেই নিয়মের লিখিত কোনো অনুলিপি সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করেননি। তিনি বলেছেন, অনুষদের ‘চেয়ারম্যানস কমিটিতে’ এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে কবে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটিও তিনি স্পষ্ট করে বলতে পারেননি।

ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের একাধিক সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপক নিশ্চিত করে বলেছেন, তাঁদের অনুষদে এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও ভর্তির সার্কুলার অনুযায়ী পরীক্ষার সব ধাপ পেরিয়েই তাঁকে সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে হয়। আর এ বিষয়ে নীতিমালা পরিবর্তনের এখতিয়ার ‘চেয়ারম্যানস কমিটির’ নেই। ভর্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে কোনো নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হলে, তা অবশ্যই একাডেমিক কাউন্সিল এবং সিন্ডিকেটে অনুমোদিত হতে হবে।

গত রোববার প্রথম আলোতে ‘পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি হয়ে ডাকসু নেতা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ছাত্রলীগের ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান নেতা ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের মাস্টার অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে ভর্তি হন। নির্বাচন করতে আগ্রহী এই ৩৪ জনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সম্পাদক ও সদস্য পদে নির্বাচনে আটজন অংশ নেন, বিজয়ী হন সাতজন। এ ছাড়া দুটি হল সংসদের ভিপি পদে অংশ নেন দুজন। এর মধ্যে একজন নির্বাচিত হন, অন্যজন পরাজিত হন। আরেকজন ছিলেন ছাত্রলীগের ডাকসু নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য। ভর্তির নীতিমালা অনুযায়ী, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল ওই প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়া যায়। কিন্তু তাঁদের কেউই তাতে অংশ নেননি। ভর্তি হওয়া একাধিক ছাত্র এবং ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক নেতা প্রথম আলোর কাছে এ কথা স্বীকার করেছেন।

প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই আজ সংবাদ সম্মেলন ডাকেন ডিন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম। ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ছাত্রলীগের ৩৪ নেতার ভর্তির বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, তাঁদের অনুষদের অনেক শিক্ষার্থী আগেই চাকরি পেয়ে যাওয়ায় মাস্টার্স করতে পারেন না। এসব শিক্ষার্থীর ইভনিং-এ পড়ার সুযোগ দেওয়া যায় কি না – দুই বছর আগে চেয়ারম্যান’স কমিটিতে এমন একটি বিষয় উত্থাপিত হয়। সভায় আলোচনার ভিত্তিতে অনুষদের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তির সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া অন্যান্য অনুষদ থেকে পাশ করা যেসব শিক্ষার্থী বিভিন্ন পেশায় আছেন, তাঁদের জন্য মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার একটি সুযোগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর উদ্দেশ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাঁরা রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট বা রেজিস্টার্ড স্টুডেন্ট – কোনো সমস্যা হলেও তাঁরা যেন এখানে পড়াশোনা করতে পারেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কেউ যদি এখানে পড়তে চান, তাদের জন্য লিখিত, মৌখিক- দুটি পরীক্ষাই দিতে হয় তাঁদের।

শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম বলেন, ‘সকল পলিটিক্যাল এফিলিয়েশনের সবাই বিভিন্ন সময়ে আমাদের এখানে আসে, বিভিন্ন সময় আমাদের কাছে অনুরোধ করে। এটা নতুন কিছু না। অনেক দিন থেকেই একজন, দুজন, পাঁচজন- আমাদের এখানে ইভনিং-এ পড়ার সুযোগ নেয়।’

২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে পাশ হওয়া সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স প্রোগ্রামের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রথমে ভর্তির বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে হবে। বিজ্ঞাপন অনুযায়ী নির্ধারিত আবেদনপত্রের মাধ্যমে ভর্তির জন্য আবেদন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে আবেদন করা যাবে। আবেদনকারীদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। এসব পরীক্ষার ফল, আগের একাডেমিক ফল এবং কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে সমন্বিত ফল তৈরি করা হবে।

ভর্তির এই নিয়মের পরিবর্তন এবং সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল বা সিন্ডিকেট অনুমোদিত কিনা- জানতে চাইলে ডিন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভনিং প্রোগ্রামগুলো অনুষদের নিজস্ব প্রোগ্রাম। এ ধরনের প্রোগ্রামে কোনো ধরনের পরিবর্তনের জন্য তাদের একাডেমিক কাউন্সিল বা সিন্ডিকেটে যেতে হয় না। তারা শুধু প্রোগ্রামের অনুমতি নেন। এরপর এই প্রোগ্রাম তারা নিজেরা পরিচালনা করেন এবং এর কোনো আইন বা কোনো কিছুর পরিবর্তন নিজেরাই করে বিশ্ববিদ্যালয়কে জানিয়ে দেন।

পরীক্ষা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভর্তির সিদ্ধান্ত কবে নেওয়া হয়েছিল- জানতে চাইলে সংবাদ সম্মেলনে ডিন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। এ বিষয়ে তার ভাষ্য ছিল- ‘এটা আমাদের ফ্যাকাল্টির সিদ্ধান্ত। আমার একজ্যাক্ট (সঠিকভাবে) মনে নেই, সম্ভবত ২০১৭ বা ১৮ সালের মার্চ বা এপ্রিলে এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল।’

ডাকসু নির্বাচনের আগে মাস্টার অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের সর্বশেষ ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে। আর নির্বাচনের পরে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি হয়েছে মে মাসে। এ দুটি বিজ্ঞপ্তির কোথাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ছাড়া ভর্তির সুযোগের কথা বলা হয়নি। এ বিষয়ে ডিন বলছেন, ‘সার্কুলার দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভর্তি করছি না। আমরা ক্লাস শুরু করার আগে সিট খালি থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সুযোগ দিচ্ছি। আমরা তো ওদের জন্য লিখিত পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা রাখি নাই। তবে ভবিষ্যতে আমরা সেটা বলে দেব। একটা বিজ্ঞাপন গেছে এখন পর্যন্ত। পরবর্তীতে যখন হবে তখন আমরা বলে দেব।’

ভর্তি নিয়ে শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের এই বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, বিভাগের পক্ষ থেকে পত্রপত্রিকায় ভর্তির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বিভিন্ন সেক্টরের অনেকেই আবেদন করেন। আবেদনের পর ভর্তির লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের আবার একটা মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। এসব প্রক্রিয়া শেষে ভর্তি নেওয়া হয়। সার্কুলারের বাইরে ভর্তির কোনো সুযোগ নেই।’

সাদেকা হালিম বলেন, ‘প্রত্যেকটি কোর্সের কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রথমে ফ্যাকাল্টি মিটিঙে আসে। ফ্যাকাল্টির ডিনের সভাপতিত্বে সকল অধ্যাপক এতে অংশ নেন। তাঁদের কোনো প্রশ্ন থাকলে প্রোগ্রাম বা কারিকুলাম রিভিজিট করা হয়। ফ্যাকাল্টিতে অনুমোদিত হলে সেটি ডিন’স কমিটিতে যায়। সেখান থেকে যায় একাডেমিক কাউন্সিলে, এর পরে যায় সিন্ডিকেটে। এসব প্রক্রিয়া শেষে ভর্তি থেকে শুরু করে অন্য সব কার্যক্রম চলে। সব ফ্যাকাল্টির জন্যই এই নিয়ম প্রযোজ্য। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’

শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম যে সময়টাতে ভর্তির নিয়মে পরিবর্তন আনার কথা বলছেন, তখন ফিন্যান্স বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন কিসমাতুল আহসান। আজ তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দিতে হবে না এমন কোনো সিদ্ধান্তের কথা তিনি মনে করতে পারছেন না। এই অনুষদের সন্ধ্যাকালীন কোর্সগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও পরীক্ষা দিয়েই ভর্তি হচ্ছে। একই কথা জানিয়েছেন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের একজন সাবেক চেয়ারম্যানও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *