আজ শুক্রবার গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস

Slider জাতীয়

ঢাকা: গুমের তালিকায় আসছে নতুন নতুন নাম। কেউ হারাচ্ছেন বাবাকে, আবার কেউবা হারাচ্ছেন তার আদরের সন্তানকে। এভাবে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গুমের শিকার হয়েছেন ৫০৭ জন। বাংলাদেশের অধিকার সংগঠনগুলোর বরাত দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতি বছর ৩০ আগস্ট গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসটি পালন করা হয়। দিবসটি জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত। দিবসটি উপলক্ষে আজ শুক্রবার সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার ও স্বজনরা আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন। অনুষ্ঠানে গুমবিরোধী বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন।

এদিকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের অব্যাহত প্রতিবাদ আর নিন্দার মধ্যেও থেমে নেই দেশে গুমের বিস্তার। দেশে গুম যেন এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ সময়ে কমপক্ষে ৮০ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে শুধুমাত্র জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যেই ১২ জন ব্যক্তি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দ্বারা গুমের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, যাদের মধ্যে দুইজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, একজন ফিরে এসেছেন, পাঁচজন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে রয়েছেন এবং বাকি চারজনের আজ পর্যন্ত কোনো খোঁজ নেই। এরপরে গত চার মাসেও অনেক স্থানে বেশ কিছু গুমের তথ্যও পাওয়া গেছে।

সূত্র আরো জানায়, ২০১৮ সালের গুমের চিত্রও ছিল ভয়াবহ। দেখা গেছে, গত বছর মোট ৯২ জন ব্যক্তি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা গুমের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, তাদের মাঝে আটজনের লাশ পাওয়া গেছে, ১০ জন ফিরে এসেছেন, ৪৭ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে এবং ২৭ জনের ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

যদিও বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন দেশে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংগঠনসমূহ এবং অধিকার সচেতন কর্মীবর্গ, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণ ও গুমের অপরাধে অভিযুক্তদের ন্যায়বিচার চাওয়ার দাবিতে সোচ্চার হতে দেখা গেছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের কাছে গুমের নিন্দা জানানোসহ একে পরিহার করার আহ্বান জানাতে দেখা গেছে।

গুম করা রোধে আইনানুগ বিধিবিধানের প্রয়োজনীয়তা থেকে ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (গুম হওয়া থেকে সমস্ত ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য ঘোষণাপত্র) গ্রহণ করে। এ ঘোষণার সূত্র ধরেই পরে গুম হওয়া থেকে সমস্ত ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ ২০০৬ প্রণয়ন করা হয়েছে, যা ২০১০ সাল থেকে কার্যকর হয়। এ সনদে অনুস্বাক্ষর করার পরে প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজ নিজ দেশে আইনগত বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়।

মানবাধিকার ও জনহিতকরণ আইন বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক দলিলগুলোকে বিবেচনায় রেখে এ সনদটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আন্তর্জাতিক সনদের ২নং অনুচ্ছেদে গুম বা এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সনদ অনুযায়ী গুম করা বলতে বুঝায় ‘রাষ্ট্রীয় অনুমোদন, সাহায্য অথবা মৌন সম্মতির মাধ্যমে কার্যত কর্মরত রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি বা এক বা একাধিক ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠী কর্তৃক সংগঠিত হয়ে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার, বিনা বিচারে আটক, অপহরণ অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণকে বুঝায়।

জাতিসঙ্ঘ সব সদস্য রাষ্ট্রকে গুম হওয়া থেকে সমস্ত ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদ (ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অভ অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস) ২০০৬ অনুসমর্থন করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। এ পর্যন্ত ৯৮টি রাষ্ট্র কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে ৫৯টি সদস্য রাষ্ট্র ইতিমধ্যে অনুসমর্থন করেছে। এশিয়ার ৯টি সদস্য রাষ্ট্র কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে এবং যার মধ্যে মাত্র ৩টি রাষ্ট্র অনুসমর্থন করেছে। বাংলাদেশ এখনো এটা স্বাক্ষর বা অনুসমর্থন কোনোটিই করেনি। গুম থেকে সুরক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধানে সুনির্দিষ্ট কিছু মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ আছে। এগুলোর মধ্যে আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভের অধিকার (৩১ নম্বর অনুচ্ছেদ), জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার (৩২ নম্বর অনুচ্ছেদ) উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও গ্রেফতারের কারণ দর্শানোর বিধান, আইনি সাহায্য লাভের অধিকার, আদালতের অনুমতি ব্যতীত কাউকে হেজাজতে না রাখার নির্দেশসহ গ্রেফতার ও আটক থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট রক্ষাকবচ (৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদ) এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের (৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদ) বিষয়টি এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। পূর্বোক্ত আইনগত সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে গুম সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে চলছে। কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা উল্লেখযোগ্য অনুসন্ধানমূলক তৎপরতার অনুপস্থিতিতে, গুমের শিকার ব্যক্তির স্বজনেরা (আইনজীবী এবং মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তায়) হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায় করেছেন। হাইকোর্ট বিভাগ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়মিত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছিলেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিবেদন কোনো প্রকার আলোর মুখ দেখেনি।

এখানে উল্লেখ্য, ২০১৪ এর এপ্রিলে সাত ব্যক্তির গুম ও পরে হত্যার ঘটনায় হাইকোর্ট নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার রায়ে কাউন্সিলর নুর হোসেন এবং সাবেক র‌্যাব অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখেছেন। এর আগে এই সাত খুন মামলায় ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের ফৌজদারি আদালত। এদের মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে বাকি ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। এছাড়া নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের রায় হাইকোর্টেও বহাল রয়েছে।
১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘ কমিটি অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস এবং ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলানটারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস সারা বিশ্ব থেকে ৫৭ হাজার ১৪৯টি অভিযোগ ১০৮টি রাষ্ট্রের কাছে পাঠিয়েছে। ২০১৮ সালে ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলানটারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস ৪০টি দেশে ৮৯২টি অভিযোগ পাঠিয়েছে।

উল্লেলখ্য, ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলানটারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারকে তাদের অভিযোগ তদন্তে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছিল এবং এর পর থেকে প্রতিবছরই এ আহ্বান জানিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি এবং অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলানটারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের স্বজন ও এর পক্ষে কাজ করা নাগরিকসমাজের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। কমিটি সংশ্লিষ্ট সরকারসমূহের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে তাদেরকে তদন্ত করতে ও তথ্য সরবরাহ করার আহ্বান জানিয়ে থাকে।

‘নিখোঁজ’ ব্যক্তির সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। গুম সংক্রান্ত অপরাধের কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে তথ্য জানা গেলেও এখন পর্যন্ত অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রেই তথ্য ও উপাত্ত পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক ফোরামের সাহায্যে বাংলাদেশে কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণও আদায় করা যায়নি। যদিও গুম সংক্রান্ত অপরাধ নির্ণয় একটা জটিল, দীর্ঘমেয়াদি ও মন্থর প্রক্রিয়াই নির্দেশ করে তবুও কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুমের শিকার ব্যক্তিদের জন্যে বিচার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সময়সাপেক্ষ হলেও ক্ষতিগ্রস্ত ও তাদের পরিবারের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং এ জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে সত্যপ্রকাশে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে চলেছে। গুমসহ ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সব ধরণের অন্যায় অবিচার প্রতিরোধ করতে মানবাধিকারকর্মীসহ প্রত্যেক নাগরিককে সোচ্চার হতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *