মনোয়ার হোসেন রনি
নদী গবেষক
গ্রাম বাংলা নিউজ২৪.কম
ঢাকা: তিস্তায় ডালিয়া ব্যারাজে উজান থেকে আসা পানি প্রবাহ প্রায় শূণ্য। ৬০০-৭০০ কিউসেক পানি যা আসছে তা ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের ভাটির উপনদী থেকে। ভারতের ব্যারাজের ডান তীরের চাহিদা হলো ১৬ হাজার কিউসেক পানি। বা তীরের চাহিদা আনুমানিক ছয় হাজার কিউসেক। আর বাংলাদেশের ডান তীরের চাহিদা আট হাজার কিউসেক। অর্থাৎ তিস্তা থেকে সর্বমোট ৩০ হাজার কিউসেক পানি দরকার। এই পরিমান পানি ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত নদীতে থাকেনা। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরও ঘাটতি থাকে। বাংলাদেশের জন্য এ সময়টায় পানি পাওয়াটা সবচেয়ে বেশি দরকার। কারণ, তাতে করে তিস্তার প্রায় ৭.৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় চাষ দেওয়া সম্ভব হবে। আমাদের জুলাই থেকে অক্টোবরে আমন মৌসুমে সম্পুরক সেচ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে টিকে থাকার জন্য নদীর নিজেরও পানি প্রয়োজন। তার জন্য ডালিয়া ব্যারাজের কিছুটা প্রবাহ ছাড়তেই হবে।
সমাধানঃ অববাহিকাভিত্তিক ও নদীভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পানি প্রবাহের সমাধান করা সম্ভব। বর্ষাকালে নদীর পানি সুবিধাকজনক স্থানে ধরে রেখে শুকনো মৌসুমে ছাড়তে হবে। তিস্তা অববাহিকায় ভারতের ছোট-বড় অনেক প্রকল্প রয়েছে। এ প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে তথ্যপ্রবাহে স্বচ্ছতা এসে সহযোগিতার পথ অবলম্বন করতে হবে। তার জন্য বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহের বড় অংশ জলাধারের মাধ্যমে ধরে রেখে শুকনো মৌসুমের প্রবাহ ধরে রাখা সম্ভব। যতদিন পর্যন্ত এই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা না যায় ততদিন একটি সম্মত বন্টন ফর্মূলায় যেতে হবে। দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তিটি স্বাক্ষরের অপেক্ষায় আছে, তাতে এটিই হয়েছে। অর্থাৎ এই ফর্মূলাতে পৌঁছানোর জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই প্রথম এবং প্রধান ভূমিকা রাখবে।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির বিষয়বস্তুঃ (ক) ২ নম্বর ধারায় বলা আছে যে, উভয় দেশ সব অভিন্ন নদীর জন্য অববাহিকা ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষে সহযোগিতা বাড়াবে। এই ধারার দুই দেশের মধ্যে বন্যা ব্যবস্থাপনা ও নৌচলাচলের ক্ষেত্রে সহযোগিতার কথা আছে। (খ) ৬ নম্বর ধারায় পরিবেশ রক্ষায় যৌথভাবে প্রকল্প হাতে নেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে।
দুই দেশের মধ্যে বর্তমানে আলাপ-আলোচনার যে প্লাটফর্ম রয়েছে তা কাজ করছেনা। ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশন স্থাপতি (জেআরসি) হয়। এই কমিশনের সূচনাপত্রে বলা আছে- দুই দেশের মধ্যে সব অভিন্ন নদীর পানি সম্পদকে নতুনভাবে উন্নীত করতে হবে। যাতে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসাধারণ উপকৃত হয়। জেআরসি’র কার্যপরিধির প্রথম ধারাটিতেও এ কথা জোরের সঙ্গে বলা আছে। তিন-চার বছর এ লক্ষে কিছু কথাবর্তা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৪ এরপর থেকে এ প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরণ বদলে যায় এবং তা বন্টনের বিষয়ে নজর দিয়ে যৌথ উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে পেছনে ফেলে দেয়। পৃথিবীর অন্য বড় নদীগুলো যেমন- থেকং, রাইন, রিওগ্র্যান্ডে ও কলম্বিয়া নদীর মতো কারিগরি ফোরাম বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যাদের দিক নির্দেশনা দেবে রাজনৈতিক মঞ্চ। ২০১১ সালের চুক্তিটি বাস্তবায়নের জন্য হয় বর্তমানে কমিশনকে ঢেলে সাজাতে হবে নতুবা নতুন প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে।
পরিশেষে, অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দুই দেশে পানি নিয়ে যা ঘটে সেসব কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা আনতে হবে। তথ্যের আদান-প্রদান সহজ করতে হবে। কারণ জনসমক্ষে সঠিক তথ্য না থাকলে ভাটির দেশ হিসাবে আমরা সন্দেহ করব এবং সন্দেহ সমাধানকে দীর্ঘায়িত করবে। দরকার জাতীয় স্বার্থে আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে অভিন্ন অবস্থান তৈরী করা। জাতীয় মতৈক্যই পারে তিস্তা প্রশ্নের সমাধান দিতে।