এমন প্রচারণা তাদের পক্ষেই সম্ভব, যারা ক্ষমতায় থাকতে চান জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া

Slider টপ নিউজ

ঢাকা: সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বই ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল’, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ নিয়ে এখন তোলপাড় সারা দুনিয়ায়। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির কিছু অভিযোগ নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সদ্য প্রকাশিত বইয়ে এসব অভিযোগের জবাব দিয়েছেন এস কে সিনহা। সাবেক এই প্রধান বিচারপতি লিখেছেন-

আশুলিয়া রোডের সঙ্গেই উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে রাজউকের বরাদ্দ করা একটি প্লট ছিল আমার। বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং করপোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে সেখানে একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ করেছি। ঋণের টাকা ও আমার হাতের অর্থ মিলিয়ে যখন নির্মাণ খরচ মেটাতে পারছিলাম না, তখন দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আত্মীয়ের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকা ধার করি। এক্ষেত্রে শর্ত ছিল বিনিময়ে তাদেরকে দিয়ে দেবো দুটি এপার্টমেন্ট। নির্মাণকাজ চলাকালে আমার স্ত্রী ও আমার জীবননাশের জন্য চারবার টার্গেট করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে আমি সিলেট সার্কিট হাউজে রক্ষা পাই। আর আমার স্ত্রী বেঁচে যান আমার গ্রামের বাড়িতে। তারপর থেকে আমার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আমার গ্রামের বাড়ি সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়। আমাদের অনুপস্থিতিতেও গ্রামের বাড়ি পাহারা দেয়ার জন্য শক্তিশালী একটি পুলিশ ফোর্স স্থায়ীভাবে মোতায়েন করা হয়। বাড়িতে দু’দফা হামলা হলেও সরকার পুরো নিরাপত্তা রক্ষাকারী ওই টিমকে প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে আমাকে এই বাড়িটি রক্ষা করতে একটি বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। কারণ, বাড়িটি গ্রামের একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে। এর দক্ষিণে আর কোনো বসতি নেই। যেকোনো সময় দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দিতে পারে বাড়িটি। তবে বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের মোতায়েন রাখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে নতুন নির্মাণ করা ভবনটিতে থাকা অনিরাপদ মনে হতে লাগলো আমার কাছে। কারণ, ওই এলাকায় দিনের বেলায়ও সশস্ত্র ডাকাতি হচ্ছিল, যদিও আমার বাড়িটির চারপাশে সীমানা দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে এ জন্য যে, ভেবেছিলাম অবসর নেয়ার পর আমি গ্রামের ওই বাড়িতে বসবাস করবো। কিন্তু তা এখন নিরাপদ নয়। আমি যদি গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করি তাহলে কে আমাকে নিরাপত্তা দেবে? কেন আমি ও আমার স্ত্রীর জীবন বারবার হুমকির মুখে পড়ছে? কেন আমাকে বারবার টার্গেট করা হচ্ছিল। সরকারে থাকলেও কোনো মন্ত্রীকে তো এভাবে টার্গেট করা হয় না। যদি কেউ দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন এবং তার কাজের স্বীকৃতি দেয়া না হয়, তাহলে কেউই দেশের স্বার্থে কাজ করবে না। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের ইচ্ছার বিষয় নয়। তবে এটা দেশের স্বার্থে করতে হয়। যেসব নাগরিক দেশের স্বার্থে, দেশের কারণে এবং দেশের নিরাপত্তার জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করছেন, তাদের সুরক্ষা দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যারা এমন কাজ করেন তারা ক্ষমতায় থাকা কোনো রাজনৈতিক দলের স্বার্থের জন্য তা করেন না। তারা এসব করেন রাষ্ট্রের স্বার্থে।

এসকে সিনহা টাকা ধার নেয়া সম্পর্কে লিখেছেন, আমি যেসব নিকটজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলাম বাড়িটি বানাতে, তাদের বলেছিলাম ওই অর্থের বিনিময়ে তারা এপার্টমেন্ট কিনেছেন। কিনেছেন এই আশা নিয়ে যে, তারা আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করবেন। তাই ছয় কোটি টাকায় তা বিক্রিতে সম্মত হয়ে একটি বিক্রির চুক্তিতে রাজি হই এবং বিক্রির চুক্তি সম্পন্ন করতে চাই। কিন্তু ক্রেতা একটি রেজিস্টার্ড চুক্তি করতে চাইছিলেন। এবং চাইছিলেন তাদের অংশ বিক্রির পাওয়ার অব এটর্নি। তিনি ও তার স্বামী বললেন যে, তারা লাভজনক (প্রফিট্যাবল) হিসেবে কিনেছেন এপার্টমেন্ট। কিন্তু যদি চুক্তিটি নিবন্ধিত হয়, তাহলে তাদেরকে রাজউকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে হবে ট্রান্সফার ফি ও রেজিস্ট্রেশন খরচ বাবদ। হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের যে বিপুল পরিমাণের ঋণ পেয়েছিলেন ক্রেতা তা আবার তারা পরিশোধ করলেন। ফলে তারা পেলেন নন-এনকামব্রেন্স সার্টিফিকেট। দুটি এপার্টমেন্টের বিপরীতে দুজনে বাকি টাকা দিয়ে দিলেন। ব্যালান্ডস এমাউন্ট চার কোটি টাকা দেয়া হলো পে-অর্ডারের মাধ্যমে। ওই পে-অর্ডার আমার একাউন্টে জমা করেছি। আমার জন্য একটি ডুপ্লেক্স এপার্টমেন্ট, বড় মেয়ের জন্য একটি আরেকটি ডুপ্লেক্স এপার্টমেন্ট কিনলাম। আমার একাউন্ট থেকে চেকের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করলাম। বাকি অর্থ সুপ্রিম কোর্ট শাখা সোনালী ব্যাংকে আমার ও ছোট মেয়ের নামে ফিক্সড একাউন্টে রাখা হলো। ছোট মেয়ে ঢাকায় এপার্টমেন্ট কিনতে রাজি ছিল না।

এসকে সিনহা লিখেছেন, আমি এবং আমার স্ত্রী নিয়মিত আয়কর বিভাগে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছি। যে অর্থ পেয়েছি এবং ফিক্স জমাসহ সব পেমেন্ট আমাদের আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করেছি। আমি প্রায় ৩৯ বছর ধরে অফিসিয়াল ওই একাউন্টটি ব্যবহার করছি তখন। সেই একাউন্ট ব্যবহার করে আমি চার কোটি টাকার পে-অর্ডর রিসিভ করবো আমি কি এতই বোকা? একজন প্রধান বিচারপতি হওয়ার কারণে প্রয়োজনের সময় আমি সম্পদ বিক্রি করার অধিকার রাখি না? আমি কি আমার আয়কর রিটার্নে কিছু লুকোচুরি করেছি?

তিনি লিখেছেন, যদি আমি আয়কর রিটার্নে কোনো কিছু এড়িয়ে যাই তাহলে কেন ওইসব প্রচারণাকারীরা আমার আয়কর রিটার্ন নিয়ে কথা বলছেন না? কেন তারা বলছেন না যে, আমার আয়কর রিটার্নে অসামঞ্জস্যতা আছে, ব্যাংকের স্টেটমেন্টে অসামঞ্জস্যতা আছে? এটা না করে তারা একজন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে গুজব ও প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এটা কতটা নৈতিক? দৃশ্যত এমন প্রচারণা তাদের পক্ষেই সম্ভব যারা ক্ষমতা ব্যবহার করতে চান, অব্যাহতভাবে ক্ষমতায় থাকতে চান জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া। এক্ষেত্রে তারা একজন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন রাষ্ট্রীয় মেশিনারি। কারণ, তিনি (প্রধান বিচারপতি) কথা বলেন, আইনের শাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে।

তিনি আরো লিখেছেন, এ পর্যন্ত আমি যেসব মামলায় রায় দিয়েছি তা যখনই তাদের পক্ষে গেছে তখন আমি তাদের কাছে একজন ভালো মানুষ ছিলাম। কিন্তু যখনই আমি সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলেছি, তখনই আমি দুর্নীতিবাজ হয়ে গিয়েছি। তারা কি পানামা পেপারস ইস্যুতে কোনো তদন্তের পদক্ষেপ নিয়েছেন? এ বিষয়ে রিপোর্ট প্রথম প্রকাশিত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টারও কম সময় পরে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, ইউক্রেনের একজন রাজনীতিক তাদের প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের প্রস্তাব রেখেছেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে পদত্যাগ করিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট, নিজেদের নাগরিকদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে অস্ট্রিয়া ও অস্ট্রেলিয়ান সরকার। কিন্তু আমরা চোখে পড়ার মতো নীরব রয়েছি। আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের অজ্ঞাতে ব্রাজিল থেকে পচা গম কিনেছেন খাদ্যমন্ত্রী।

এ বিষয়ে আমরা তার বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত করিনি। গম কেনায় দূতাবাসকে জড়িত করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু যখন খবর প্রকাশিত হলো তখন খাদ্যমন্ত্রী দূতাবাসকে জড়িত করতে চাইলেন। কিন্তু দূতাবাস তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। দুর্নীতির বিষয়ে আমি অনেক কিছু বলতে চাই না। আমি অভিযোগ জমা হওয়ার একটি বাক্স সংরক্ষণ করি। বাস্তবে তাতে অনেক ডকুমেন্ট পেয়েছি।
আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে, কীভাবে মো. আবদুল ওয়াহ্‌্‌হাব মিয়ার মতো একজন বিচারক, যার ওপর আমি আস্থা রেখেছিলাম, যাকে একটি আলাদা বেঞ্চ দিয়েছি, সব বিচারিক কর্মসূচিতে যেসব কমিটি গঠন করেছি আমি সেখানে তাকে চেয়ারম্যান বানিয়েছি, যা আমার পূর্বসূরিরা তাদের ক্ষমতার মেয়াদে করেননি, সেই ওয়াহ্‌্‌হাব মিয়া কীভাবে আমাকে না জানিয়ে আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে পারেন। তিনি এটা করেছেন দুজন সিনিয়র আইনজীবী ও আনিসুল হকের পরামর্শে। আইনমন্ত্রী, যার আগে থেকেই ওইসব অভিযোগ ওয়েবসাইটে প্রকাশের প্রস্তুতি ছিল, তার হাতের খেলার পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্‌্‌হাব মিয়া।

তবে এসব দুর্নীতির অভিযোগ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির কোনো নির্দেশনা, কোনো সার্কুলার ছিল না। কোনো সংবাদ জানানো হয়নি। তখনও আমি প্রধান বিচারপতি। কিন্তু বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্‌্‌হাব মিয়া প্রধান বিচারপতিকে ডিঙ্গিয়ে ওই অভিযোগগুলো আইনমন্ত্রীর খায়েশ অনুযায়ী প্রকাশ করে দিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *