গাজীপুরে সাংবাদিকদের চার বছর- চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি

Slider টপ নিউজ সারাদেশ

গাজীপুর অফিস: ২০১৬ সালের ২০ জুন। রমজান মাস। ইফতারের আগেই সংবাদ আসল গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হচ্ছে রক্তাক্ত কয়েকজন জন সাংবাদিককে। গিয়ে দেখলাম তিনজন সহকর্মী রক্তাক্ত। জরুরী বিভাগে যেতেই চোখ লাল হয়ে গেলো। রক্তাক্তদেহের তিন সহকর্মীর মধ্যে কাকে রেখে কাকে জড়িয়ে ধরি বুঝে উঠতে পারিনি। তবে সবাইকেই বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আর আমাদের সকলের চোখ দিয়েই পানি ঝরেছিল। আবেগঘন মূহুর্ত থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের গেটে গেলাম। সেখানে দেখি দাঁড়িয়ে আছেন তৎকালিন পুলিশ সুপার হারুনর রশীদ ও আমাদের কয়েকজন সহকর্মী। এই ঘটনায় কি করা যায় তা নিয়ে ছোট করে আলোচনা চলছে। আমিও যোগ দিলাম। কিন্তু কোন কথা তেমন ভাবে বলা হয়নি। এসপি সাহেব শুধু বলেছিলেন, কি করা যায়। আমি বলেছিলাম মাত্র ঘটনা ঘটল। দেখা যাক। এরপর জানলাম, আহত সহকর্মীদের চিকিৎসার ব্যায়ভার বহন করছে পুলিশ।

এখানে বলে রাখা উচিত, ২০১৬ সালের ২০ জুন বিকাল ৫টার দিকে গাজীপুর সদর উপজেলার বাঘেরবাজার এলাকায় জুয়াড়িদের হামলায় তিনজন সাংবাদিক আহত হয়েছিলেন । জুয়ার আসর নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে এ ঘটনা ঘটে।

আহত ব্যক্তিরা হলেন আরটিভির আজহারুল হক, জিটিভির মো. আবদুল্লাহ আল মামুন ও মোহনা টেলিভিশনের মো. আতিকুর রহমান। তাঁরা সবাই গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত।

আহত সাংবাদিকেরা বলেন, তাঁরা তিনজন ও একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিক ইকবাল সরকার গতকাল বিকেলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক নিয়ে প্রতিবেদন করতে শ্রীপুর উপজেলার মাওনা এলাকায় যান। সেখান থেকে ফেরার পথে গাজীপুর সদর উপজেলার বাঘেরবাজার এলাকায় দেখেন এক জায়গায় অনেক ব্যক্তিগত গাড়ি জড়ো হয়ে আছে। তখন তাঁরা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, সেখানে জুয়া ও অশ্লীল নৃত্যের আসর বসানো হয়েছে।

এ খবর শুনে তাঁরা সেখানে গিয়ে ছবি তুলতে থাকেন। এ সময় জুয়ার আসরের ১৫-১৬ জন তাঁদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় ইকবাল সরকার পালিয়ে এলেও জুয়াড়িরা অন্য তিনজনকে আটক করে ও লাঠিসোঁটা দিয়ে বেদম মারধর করে। হামলাকারীরা তাঁদের ক্যামেরা, মুঠোফোন ও টাকা লুট করে নেয়। পরে আশপাশের লোকজন তাঁদের উদ্ধার করে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান।

এই ঘটনার পরদিন সহকর্মী মীর ফারুক(বাংলাভিশন) তার নিজ ফেইসবুক ওয়ালে ওই ঘটনার প্রতিবাদে সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে একটি মানববন্ধন কর্মসূচি আহবান করেন। ঠিক ওই সময় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধনের জন্য আমরা কয়েকজন উপস্থিত হই। কিন্তু অনেক সময় চলে গেলেও আর কারো দেখা মিলেনি। আন্দোলন আহবানকারীকে ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। তারপর নতুন আশঙ্কার মধ্যে পড়ে জানতে পারলাম, আন্দোলনকারীরা সবাই এসপি অফিসে এবং সেখান থেকে তারা মানববন্ধন স্থগিত করেছেন বলে খবর দেয়া হয়।

অবেশেষে হতাশ হয়ে ফিরে গেলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আহত সাংবাদিকদের সাথে হামলাকারী জুয়াড়ীদের আপোষ করে দিয়েছেন পুলিশ সুপার সাহেব। নিঃসন্দেহে এটা ভাল খবর। তবে ওই ঘটনায় ১০ জুয়াড়ীর নামে মামলা হলেও কেউ গ্রেফতার হয়নি। বরং ২দিন পরই ওই ঘটনাস্থলে আবার জুয়া চলেছে। পরবর্তি সময় ওই জুয়ার আসরে দুই জন ব্যাক্তিও জুয়া চলা অবস্থায় খুন হয়েছেন। তবুও বন্ধ হয়নি জুয়ার আসর।

এদিকে সংবাদ প্রকাশের জেরে গ্রেফতার হয়ে ১৭দিন কারাগারে ছিলেন গাজীপুরের স্থানীয় দৈনিক মুক্তসংবাদের সম্পাদক সোহরাব হোসেন। সোহরাব হোসেন একজন পঙ্গু মানুষ, যিনি লাঠিভর দিয়ে চলেন। তাকে তার কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। জামিন হওয়ার পর জেল গেট থেকে আবারো আটক হন সোহরাব হোসেন। পরে ডিবিতে কয়েক ঘন্টা আটকে রেখে মুচলেকা নিয়ে তাকে ছাড়া হয়।

ঢাকার একটি অনলাইন পত্রিকার সূত্র ধরে একটি সংবাদ প্রকাশ করায় গাজীপুরের আরেকটি স্থানীয় দৈনিক মুক্তবলাকার সম্পাদক সহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়। মামলা হওয়ার আগেই ওই সম্পাদকের বাড়িতে হানা দেয় ডিবি পুলিশ।

তথ্য জানতে গিয়ে হুমকির শিকার দৈনিক গণমুখের সম্পাদক ও প্রকাশক অধ্যাপক আমজাদ হোসেন। কালিগঞ্জ থানার ওসি আলম চাঁন তাকে হত্যার হুমকি দেয় বলে অভিযোগ নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলনও হয়েছে। আর এতে বেশ কিছু দিন নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন ওই সম্পাদক।

পুলিশের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গাজীপুর ডিবিতে গ্রেফতারের পর দুই দিনের রিমান্ডেও গিয়েছিলেন সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী। এক মামলায় জামিন হওয়ার পর মুক্তি পেলেও জেল গেটে থেকে আরেক মামলায় তাকে আটক করে পুলিশ।

জুয়ার সংবাদ দেয়ার কারণে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা হয় তৎকালিন সাপ্তাহিক বাংলাভূমি ও বর্তমানে দৈনিক বাংলাভূমি পত্রিকার সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজহারের বিরুদ্ধে।

দুধের শিশু ঘরে রেখে গ্রেফতার হন এক নারী সাংবাদিক। হোটেলে যৌন ব্যবসার প্রতিবাদ করায় রক্তাক্ত জখম হন সাংবাদিক তুহিন সারোয়ার। একাধিকবার সন্ত্রাসী আক্রমনে আহত হন সাংবাদিক আঃ আজিজ। এসপিকে আমন্ত্রনপত্র দিতে গিয়ে গ্রেফতার হন আরো দুই সাংবাদিক। গ্যাসের দাবিতে জনগনের মানববন্ধন চলাকালে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জে আহত হন সাংবাদিক মাসুদ সহ কয়েকজন। তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিলেন সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম। একই কারণে পূবাইলে রক্তাক্ত জখম হয়ে আহত হন সাংবাদিক জসিম উদ্দিন ও চান মিয়া মুন্সি।

গত ৪বছরে সংবাদ প্রকাশের কারণে মিথ্যা মামলার আসামী হয়ে কারাগারে ছিলেন প্রায় ডজনখানে সাংবাদিক। আহত হয়েছেন প্রায় ৯জন সাংবাদিক।

এখানে বলে রাখা ভাল যে, ইতিহাস খ্যাত ভাওয়াল পরগণার গহীনবনাঞ্চল আর গৈরিক মৃত্তিকাকোষের টেকটিলায় দৃষ্টিনন্দন ঐতিহাসিক এ জনপদ ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ গাজীপুর জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮৩ সালে মহুকমা থাকা অবস্থায় গাজীপুর জেলার জন্ম। এরপর থেকে গাজীপুর জেলায় সাংবাদিক সমাজের প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কাজ শুরু হয়। “হাঁড়ির সঙ্গে হাঁড়ির সংঘর্ষ” প্রথার মতই শুরু থেকেই কিছু কিছু করে কোন্দল ছিল সাংবাদিক সমাজে, যা সকল জায়গাই আছে। কিন্তু কোন দিন এক সঙ্গে ৩/৪ জন সাংবাদিক রক্তাক্ত জখম হননি। সাংবাদিক আহতের প্রতিবাদে রাজপথে প্রতিবাদ করা যায়নি এমন ঘটনাও ঘটেনি। গত চার বছরে গাজীপুরের সাংবাদিক সমাজ যেভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, তা জেলার সকল ইতিহাসকে ভঙ্গ করেছে।

কালকে আসছে– “কেন এমন ছিল ওই সময়!”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *