সাম্প্রতিক কিশোর বিদ্রোহ: নতুনের আগমনী বার্তা

Slider বাধ ভাঙ্গা মত

ঢাকা: সম্প্রতি নিরাপদ সড়ক নিয়ে ঢাকা শহরের শিশু-কিশোরদের রাস্তায় প্রতিবাদের যে অভাবনীয় চিত্র আমরা দেখি, ইতিহাসে তার জুড়ি মেলা ভার। সাম্প্রতিক শিশু-কিশোর আন্দোলন আমাদের শুধু এটাই দেখাচ্ছে না, বড়দের মতো সচেতন আন্দোলন তারাও করতে পারে; সঙ্গে এটিও দেখাচ্ছে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে তারা প্রতিরোধও গড়তে পারে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আমার চোখে পড়েছে, মানুষের জীবনের সাবালকত্বের বয়স বয়সের ক্রম অনুযায়ী বাড়ে না, বরং বিশেষ স্থান, কাল ও সংস্কৃতি ভেদে মানুষের সত্তা বিভিন্নভাবে নির্মিত হয়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকায় ঘটে যাওয়া কিশোর বিদ্রোহ এর জলজ্যান্ত প্রমাণ। কীভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও প্রশিক্ষণের অভাবে এবং সারিবদ্ধভাবে গাড়ি না চালানোর কারণে অবিরাম সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে এবং শিশু-কিশোরেরা অকালে জীবন হারাচ্ছে, তার সাক্ষাৎ প্রমাণ হাজির করেছে একেবারে চোখের সামনেই।

বৃহত্তর পরিসরে আমরা দেখি, কোনো কোনো মন্ত্রী, এমপি, উচ্চপদস্থ আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা ও অন্যান্য নাগরিকের গাড়ি এবং ব্যাপকসংখ্যক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই কিংবা মালিকের গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট তামাদি হয়ে গেছে। শিশু-কিশোরেরা নিজেরাই ট্রাফিক বনে গিয়ে রাস্তা পারাপারে সহযোগিতা করেছে; যানজট কমিয়েছে; অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কার ও রিকশার জন্য পৃথক লাইন তৈরি করে দিয়েছে। নাগরিক জীবনে কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন ছিল, আহা কবে কে কখন এই দৃষ্টিনন্দন ঢাকা শহর দেখেছিল? এক কথায়, গত আট-নয় দিনে তাক করে দেওয়া শিশু-কিশোরদের এই কর্মসূচি স্কুলের গণ্ডিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে ঢাকার রাজপথে সুদক্ষ ট্রাফিক হিসেবে আমাদের সামনে হাজির করে। এই ‘বড় হয়ে ওঠা’ কিশোরেরা তাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে শিক্ষা পেয়েছে; প্রতিদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য যে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়, তা দেখছে; যখন বাসের জন্য হাত তুলেও গাড়ি থামে না বা থামলেও জায়গা পায় না বা স্থির জ্যামের কারণে সময়মতো স্কুলে বা বাসায় পোঁছাতে পারে না, তখন তারা বীতশ্রদ্ধ হয়। সঙ্গে অভিভাবকদের নিদারুণ কষ্টও তাদের প্রভাবিত করে।

বিশেষ অবস্থায় বিশেষ সংস্কৃতিতে শিশু-কিশোরেরা সচেতন সত্তা হিসেবে ধাতস্থ হয়। স্কুলের ‘সুবোধ’ ‘অবুঝ’ ‘আন্ডাবাচ্চা’ হয়ে ওঠে ‘বড়’ ‘ম্যাচিউরড’ ও ‘অভিজ্ঞ’ নাগরিক। এ থেকে একটি অনুসিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছে যাই তা হলো: কৈশোরের পরিচিতি কখনোই নির্দিষ্ট নয় এবং তা সময় ও প্রেক্ষিতনির্ভর। তা বিশেষ স্থানিক মানচিত্রে, বিশেষ সাংস্কৃতিক আবহে পরিবর্তিত হয়। সে দিক থেকে বাংলাদেশে গত সপ্তাহে কিশোরদের আন্দোলন ও তৎপ্রসূত রাস্তায় শান্তিপূর্ণ অহিংস বিদ্রোহের আগুন আমাদের মনে দাগ না কেটে পারে না। অপর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো: বিদ্যমান ট্রাফিক ব্যবস্থার বিপরীতে কিশোরেরা একটি সাংস্কৃতিক কর্তাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যার রয়েছে নজরকাড়া শৈলী আর উদ্ভাবন। আমার মনে হয়েছে শিশুরা বড়দের অনুশীলনকে অনুসরণ করেনি, বরং নিজেদের মতো করে ঢাকার অব্যবস্থাপনায় ভরপুর ট্র্যাফিক ব্যবস্থার বিপরীতে সৃষ্টিশীল পরিশীলিত চিন্তাধারা দাঁড় করিয়েছে। এটিই সদ্য ঘটে যাওয়া কিশোর আন্দোলনের প্রাণভোমরা।

এই ‘সাংস্কৃতিক কর্ম’ রাষ্ট্রের অনিয়মের সংস্কৃতিকেও ধাক্কা দিয়েছে। সোজা কথায়, শিশুরা বড়দের মতো নয়। বিপরীতে বড়রা ভাবতে শুরু করেছে, শিশুরা যা হয়েছে, তাঁরাও সেটাই হতে চান। ডিএমপির চলমান ট্রাফিক সপ্তাহ পালন তার ইঙ্গিতই দেয়। সে দিক থেকে শিশুরা হয়ে উঠেছে তারই বড় দ্যোতক।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে সাংস্কৃতিক উদ্ভাবক হিসেবে শিশু-কিশোরদের ভূমিকা বোঝা জরুরি। এখানে রাষ্ট্র, ট্রাফিক আইন, নিয়ম আর আন্তরিকতার সম্পর্ক হয়ে ওঠে পরিপূরক। ঢাকা শহরের তীব্র যানজটের কারণ যে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি, অপ্রশিক্ষিত চালক এবং ঘুষ-দুর্নীতি—এ সবই শিশুরা চ্যালেঞ্জ করেছে। আমরা দেখি, প্রভাবশালী মন্ত্রীর গাড়ি যখন উল্টো দিকে চলে, তখন তিনি বাধাগ্রস্ত হন। বিনয়ের সঙ্গে বাচ্চারা মন্ত্রী মহোদয়কে বলে, ‘স্যার দিস ইজ নট দ্য রাইট ওয়ে, গো ব্যাক স্যার, প্লিজ।’ দুর্ঘটনা রোধের জন্যে এটি শিশু-কিশোরদের প্রতীকী প্রতিবাদ।

মনে হতে পারে এই ‘সাংস্কৃতিক কর্ম’ ‘বাড়াবাড়ি’, কিংবা ‘অস্বস্তিকর’। এটাও এক নতুন শিক্ষা সবার জন্য। অন্যদিকে এই ‘সাংস্কৃতিক কর্ম’ এমন একটি চেতনা সৃষ্টি করেছে জনমনে, যা প্রকৃত অর্থেই আগ্রহ উদ্দীপক। এটি এমন একটি শৈলী, যা আর্ট অব পারফরম্যান্স। এই ক্ষেত্রে যে স্লোগানগুলো প্ল্যাকার্ডে শোভা পাচ্ছিল সেগুলো ছিল চিত্তাকর্ষক অথচ চেতনাসঞ্চারক: ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ’ ইত্যাদি।Eprothomalo

শিশুদের সুশৃঙ্খল প্রতিবাদের সারিবদ্ধ লাইনগুলো আমাদের নিয়ে যায় এমন এক স্বপ্নিল রাজ্যে, যা মনে করিয়ে দেয়, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’। এটি জাগরণের নতুন এক সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি করে—মানুষ হতবিহ্বল হয় না, কেবল অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে এই শিশুদের দিকে। কী অপার সম্মোহনী ক্ষমতা রয়েছে, যা সবাইকে ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করছে। প্রচণ্ড খরতাপে স্কুলের ড্রেস পরা পিঠে ব্যাগ নিয়ে ঘর্মাক্ত কিশোরী রিকশাওয়ালাকে চকলেট বা আইসক্রিম তুলে দিচ্ছে হাতে, রিকশাওয়ালা শুধু অবাকই হয় না, সমীহ করে বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এই এক অপার দৃশ্য, যা বাচ্চাদের আকাশছোঁয়া উচ্চতায় নিয়ে যায়। মন ছুঁয়ে যায় যখন দেখি অভিভাবকেরা নিজের বাচ্চাসহ আন্দোলনে হাজির হন। আমি আমার বাচ্চাকে নিয়ে লাইনে দাঁড়াই; বারবার দেখি লাইন ঠিক আছে কি না? আমি আপ্লুত হই যখন দেখি, মায়েরা বড় পাত্রে খিচুড়ি নিয়ে আসছেন; বাচ্চারা মিছিল করে ক্লান্ত হয়ে আদুরে মায়ের হাতে নলা ধরে খেয়ে যাচ্ছে একে একে। অভাবনীয় দ্যোতনা তৈরি হয়ে যায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে জমায়েত হওয়া ছোট-বড় সবার মধ্যে।

সার্বিকভাবে আমার কাছে মনে হয়েছে, এই আন্দোলন হচ্ছে একটি বিকল হওয়া ট্রাফিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে শিশু-কিশোরদের সরব অথচ অহিংস প্রতিরোধ। সুশৃঙ্খল ঢাকার উদ্ভাবক এই শিশু বার্তাবাহকদের বরণ করতে যেন দেশবাসী প্রস্তুত। এই যেন সেই ‘গডো’র জন্যে জন্মান্তর প্রতীক্ষা (Waiting for Goddot), যাকে দেখার জন্য সবাই মুখিয়ে আছে।

অনেকেই বলেন, শিশু-কিশোররা একটি জর্জরিত সড়ক ব্যবস্থাপনার অসংগতিগুলো তুলে ধরেছে এবং নতুন নিয়মের অভিষেকও ঘটিয়েছে। নিরাপদ সড়কের এই আন্দোলন কি কিশোর-কিশোরীদের ভাবনাজাত রোমান্টিকতা? নাকি ‘ইঁচড়ে পাকা’দের কোনো এক বালখিল্য? মনে হয় এর উত্তর খুঁজতে হবে অনেক গভীরে। ঢাকার দুর্ঘটনা ও যানজট নিরসনে যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাংক, দেশি-বিদেশি গবেষকসহ নানা কর্তৃপক্ষের যে প্রাণাতিপাত প্রচেষ্টা বিফলে যেতে বসেছে, তার জন্য শিশু-কিশোরদের চেতনা উদ্দীপক এই আন্দোলন গাইডলাইন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। শিশু-কিশোরদের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবস্থাপনা হতে পারে কল্পনা; কিন্তু এই ব্যবস্থাপনা কল্পিত নিরাপদ সড়কের জন্য তৈরি করা এবং যা তাদের জীবন থেকে উৎসারিত একটা আদর্শ উদাহরণ।

নানান রাজনৈতিক পঙ্কিলতা এই শিশু-কিশোরদের মনন, শরীর আর স্মৃতিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। তাদের ঘরে ফেরা না-ফেরা বিতর্ক কতটা সুখকর হয়েছে, তার বিচার করবে দূর ইতিহাস; কিন্তু চলমান ও নিকট ভবিষ্যতে ওই সূর্যসন্তানদের আগমনী বার্তা এবং সম্মোহনী ক্ষমতা যা শিখিয়েছে আমার মতো বড়দের, তা অনেক অনেক দিন এ দেশের অহংকার হয়ে থাকবে। তোমরা অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষি। অভিবাদন তোমাদের।

ড. জহির আহমেদ, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *