নিরাপদ সড়ক আন্দোলন : আতঙ্কে ভুগছেন অনেক শিক্ষার্থী

Slider জাতীয়

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন ছাত্রকে রিমান্ডে নেয়ার পর ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক শিক্ষার্থী বলছেন যে এই ঘটনা তাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে।

পুলিশ জানিয়েছে, গত সোমবার বসুন্ধরা এবং বাড্ডা এলাকায় সংঘর্ষ ও সহিংসতার সাথে জড়িত সন্দেহে এবং পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে এসব শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে নয় দিন ধরে চলা আন্দোলনের সময় সংঘটিত নানা ঘটনায় ঢাকার ১৬টি থানায় ৩৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এ পর্যন্ত মোট ৪৫ জনকে আটক করা হয়েছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক শিক্ষার্থী বিবিসি র সাথে কথা বলেছেন, তবে তারা তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি। এসব শিক্ষার্থীদের অনেকে বলেছেন, মামলাগুলোতে অজ্ঞাতনামা হিসেবে অনেককে অভিযুক্ত করায় তাদের মধ্যে গ্রেফতার আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

এসব মামলায় এ পর্যন্ত যাদের আটক করা হয়েছে, বেশিরভাগই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনে সরব উপস্থিতি ছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের, তবে তাদের কাউকে আটক করা হয়নি বলে পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

তবে গ্রেফতার এবং রিমান্ডে নেয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকার দমননীতির দিকে এগুচ্ছে কি-না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান।

তিনি এমন অভিযোগও করেছেন যে যারা হেলমেট পড়ে, লাঠিসোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, মামলাগুলোতে পুলিশের কাজে বাধা দেয়া এবং সহিংসতার অভিযোগ আনা হয়েছে।একইসাথে স্কুল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উস্কানি দেয়া এবং সামাজিক নেটওয়ার্কে গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে এসব মামলায়।

বেসরকারি নর্থ সাউথ এবং ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ছাত্রলীগের একদল সদস্য লাঠিসোটা নিয়ে পুলিশের উপস্থিতিতে গত সোমবার দফায় দফায় তাদের উপর হামলা করেছিল, অথচ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

ফলে তাদের মধ্যে এখন গ্রেফতার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বলে তারা জানাচ্ছেন। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকার রাস্তায় আন্দোলনের পর স্কুল শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে ক্লাসে ফিরে গেছে।

এই আন্দোলনের শেষের দিকে গত রোববার এবং সোমবার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। সোমবার ইস্ট ওয়েস্ট এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর হামলার পর সুন্ধরা আবাসিক এলাকা এবং বাড্ডায় পুলিশের সাথে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই বিশ্ববিদ্যালয় দু’টির ক্লাস এখন বন্ধ আছে।

এই প্রেক্ষাপটে বুধবার শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠকে বসেন।
কতটা বিপজ্জনক বাংলাদেশের সড়ক
বিবিসি
ঢাকায় বাসের ধাক্কায় দু’জন স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের দাবীতে শুরু হওয়া ছাত্র বিক্ষোভ সাড়া তুলেছে পুরো বাংলাদেশে।

২৯শে জুলাই ঐ দুর্ঘটনা হওয়ার পরে ছাত্র বিক্ষোভের খবর মূলত সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পরে। এরপর প্রথম কয়েকদিন স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও পরবর্তীতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হয় ঢাকায়।

নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা আর পরিবহন খাতের উন্নয়নের জন্য শিক্ষার্থীদের নানামুখী দাবির ‘দ্রুত ও আইনানুযায়ী বাস্তবায়নের’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের আন্দোলন বন্ধ করতে বলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সড়কে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে যখন একটি দেশের স্কুল পড়ুয়া কিশোর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বিক্ষোভে নেমে আসে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেদেশের সড়ক পরিবহন খাতের অবস্থা কতটা আশঙ্কজনক তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশের সরকারি রেকর্ডে সড়কে যে পরিমাণ মানুষের মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনার উল্লেখ করা হয়, বাস্তব সংখ্যাটা তার চেয়ে অনেক বেশি।

সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে বাংলাদেশের সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৭,৩৪৯ থেকে ২৫,২৮৩ এর মধ্যে। ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঐ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঐ প্রতিবেদন তৈরীতে সরকারি তথ্যের পাশাপাশি আইনি প্রতিবেদন ও স্থানীয় সমন্বয়কদের বক্তব্যের ওপরও নির্ভর করা হয়। স্থানীয় সমন্বয়করা প্রতিবেদন তৈরীর ক্ষেত্রে নানা ধরণের জরিপ পরিচালনা করার পাশাপাশি আইন, স্বাস্থ্য ও পরিবহন খাত সহ এই বিষয়ে হওয়া গবেষণা থেকেও তথ্য নেন।

অন্যদিকে সরকারি হিসেব অনুযায়ী ২০১৩ সালে সড়কে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে মাত্র ৩,২৯৬টি।

সংখ্যায় এত হেরফের হওয়ার কারণ কী?
বাংলাদেশের নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে কাজ করা সংস্থখাগুলো বলছে, সরকারি হিসেবের প্রধান ভিত্তি পুলিশের রিপোর্ট, যেখানে অনেক দুর্ঘটনার খবরই উঠে আসে না।

গতবছর বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট হতাহতের সংখ্যা নিয়ে তৈরী করা ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয় এসব ক্ষেত্রে ‘কুরুচিপূর্ণভাবে’ কম সংখ্যক দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ করে পুলিশ।

বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বহুবছর ধরে প্রচারণা চালানো বেসরকারি সংস্থা নিরাপদ সড়ক চাই’এর প্রধান ইলিয়াস কাঞ্চন বিবিসিকে বলেন: ‘দুর্ঘটনা ঘটার পর সবাই কিন্তু পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে যায় না। আর যারা যায়, তাদের সহায়তা করতে যে সবসময়ই পুলিশ কার্যকর ভূমিকা রাখে, এমনটিও নয়।’

সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী হারানো ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, তাঁর সংস্থার মত অনেক প্রতিষ্ঠানই সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নির্ণয় করতে পুলিশি ও সরকারি তথ্যের পাশাপাশি জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদপত্র, টেলিভিশনের খবর ও সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করে।

একটি বাংলা দৈনিকে সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে আসে যে গত সাড়ে তিনবছরে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৫,০০০ মানুষের।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক ও সড়ক দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ ড. এম.বি. শামসুল হক দেশের বিভিন্ন থানার পুলিশ ও প্রধান প্রধান সড়কে কাজ করা শুল্ক কর্মকর্তাদের বক্তব্য নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছেন।

বিবিসি’র রিয়েলিটি চেক অনুষ্ঠানে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সরকারি হিসেবে যেই সংখ্যা পাওয়া যায় সেটিকে কমপক্ষে দুই বা তিন দিয়ে গুণ করলে সঠিক সংখ্যা পাবেন আপনি।’

এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা কী?
সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমতির দিকে ছিল। ২০১৪’র পর থেকে এই সংখ্যা আবার বাড়তে থাকে।

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ মানুষে মৃত্যুহার ছিল ১৪.১, যা ২০১৫’তে কমে দাঁড়ায় ১২.৮ এ। তবে এই সংক্রান্ত সাম্প্রতিকতম তথ্য পাওয়া যায়নি।

২০১৫’র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশী।

বৈশ্বিকভাবে হিসেব করলে, সবচেয়ে নিরাপদ সড়ক ইউরোপে। আফ্রিকা, এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু অঞ্চলের সড়ক পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ।

যুক্তরাজ্যের সংসদের জন্য তৈরী করা এই বছরের এক প্রতিবেদনে বলা হয় ২০১৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুহারের হিসেবে সবার ওপরে ছিল আফ্রিকা, যেখানে প্রতি এক লাখ মানুষে মৃত্যুহার ২৬.৬ জন। আর সর্বনিম্ন ইউরোপ, প্রতি লাখে ৯.৩ জন।

বাস্তবায়ন ও আইনি জটিলতা
সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার তাগিদ দিয়ে বহুবছর ধরে প্রচারণা চালাচ্ছেন ইলিয়াস কাঞ্চনসহ অনেকেই।

কাঞ্চনের মতে নানাবিধ কারণে এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য মোজাম্মেল হক সম্প্রতি বিবিসি’কে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মাত্র ২০% তাদের দুর্ঘটনার পর আইনি সহায়তা নিয়ে থাকেন, যদিও কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে এই দাবির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র প্রতিবেদনে, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর ঘটনায় শাস্তি দেয়ার বিচারে, দশের মধ্যে তিন পয়েন্ট দেয়া হয় বাংলাদেশকে।

তবে বর্তমানে বাংলাদেশের সরকার বলছে যে তারা এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *