বিশ্বসেরার হাতছানি মডরিচের

Slider খেলা

image-69935-1531549566

কেউ ভাবেননি তিনি ফুটবলার হবেন। হয়েছেন।

কেউ ভাবতে পারছেন না, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসিকে ছাপিয়ে কেউ বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিততে পারেন। ১০ বছর ধরে যে সেটি দেখেই অভ্যস্ত সবাই! এখন সবার সেই ভাবনাকেও ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পারছেন তিনি।

লুকা মডরিচ এমনই এক জাদুকর! বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্নযাত্রার মহানায়ক। আজ যদি ফ্রান্সকে হারিয়ে সত্যি চ্যাম্পিয়ন হতে পারে তাঁর দল—বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের দাবির পালে লাগবে জোর হাওয়া। বিশ্বকাপের মঞ্চে পুরোটা সময় অমন খেলেন যিনি, সেই মডরিচের কাছে তখন অবসান হতে পারে মেসি-রোনালদোর দ্বৈতশাসন।

ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক তিনি। মিডফিল্ড জেনারেলও। বিশ্বকাপে দেশের ছয় খেলার মধ্যে তিনটিতেই আনুষ্ঠানিক ম্যাচ অব দ্য ম্যাচ। বাকিগুলোতে অনানুষ্ঠানিক। ডেনমার্কের বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে কোয়ার্টার ফাইনালে তোলার সুযোগ এসেছিল মডরিচের সামনে। পারেননি। তবে পেনাল্টি মিস করেও হননি লক্ষ্যচ্যুত। এ কারণেই তো টাইব্রেকারে আবার পেনাল্টি নিতে যান ঠিকই। করেন গোল। দলও পেয়ে যায় কোয়ার্টারের টিকিট। সেখানে রাশিয়া ও সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে এখন স্বপ্নপূরণের শেষ ধাপে ক্রোয়েশিয়া। আজকের শেষ মহারণে তাই ফুটবলশিল্পী মডরিচের দিকে খুব করে তাকিয়ে পুরো ক্রোয়েশিয়া।

তাঁর ভাবনার ল্যাম্পপোস্টেও জ্বলছে এই একটিই বাতি—বিশ্বকাপ জয়। সেখানে মেসি-রোনালদোকে ছাপিয়ে বিশ্বসেরা খেলোয়াড় হওয়ার চিন্তা নেই একেবারে। বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও আগাম উল্লাস নেই মডরিচের কণ্ঠে, ‘কয়েকবারই বলেছি, আমার সব মনোযোগ ক্রোয়েশিয়ার সাফল্যে। সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারের আলোচনায় আমার নাম থাকাটা সম্মানের; আনন্দের। তবে আমি তাতে ভেসে যাই না। আমি শুধু চাই, আমার দল যেন কাল বিশ্বকাপ জেতে। অন্য কিছু আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। আর ব্যক্তিগত পুরস্কার জয় আমার অগ্রাধিকার নয়।’

বল পায়ে শিল্পীর জীবন কিন্তু যোদ্ধার। সেই শৈশবে সাক্ষী হয়েছেন যুদ্ধের ভয়াবহতার। ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মেরে ফেলা হয় মডরিচের দাদাকে; তাঁরা পালিয়ে যাওয়ার পরপরই পুড়িয়ে দেওয়া হয় বাড়িঘর। শরণার্থী হিসেবে দীর্ঘ সময় ছিলেন জাদার শহরের এক হোটেলে। মোটর মেকানিক বাবা ও গার্মেন্টের কাজ করা মাকে জ্বালাতেন না খুব একটা। দিনমান পড়ে থাকতেন ফুটবল নিয়ে। হোটেল করিডরে খেলতে খেলতেই শিখেছেন খেলা। ওই খেলতে খেলতেই হন পেশাদার ফুটবলার। রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবে খেলেন দাপটের সঙ্গে। এখন ক্রোয়েশিয়া দলকে নিয়ে চলে আসেন বিশ্বকাপের ফাইনালে।

জীবনের ওই কঠিন সময়টা দেখেছেন বলেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগের দিন কাল এমনটা বলেছেন মডরিচ, ‘জীবনে অনেক কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে গিয়েছি আমি। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কখনো হাল না ছাড়া। কখনোই পরিস্থিতির কাছে নিজেকে সঁপে না দেওয়া। যাই হোক না কেন, নিজের সামর্থ্যের ওপর আস্থা রাখতে হয়। স্বপ্ন পূরণের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। এটিই আমার বরাবরের প্রেরণা। এই মন্ত্র আমাকে নিয়ে এসেছে আজকের অবস্থানে।’ অথচ লিকলিকে এই ছেলে ফুটবলার হবে—তা ভাবেননি অনেকে। শারীরিকভাবে ছোটখাটো ও অপুষ্ট শরীরের কারণে হাইদুক স্লিট ক্লাব প্রত্যাখ্যান পর্যন্ত করেছিল মডরিচকে। কাল মস্কোর সংবাদ সম্মেলন কক্ষে বসে মনশ্চক্ষে সেই দিনগুলো নিশ্চয়ই দেখছিলেন মডরিচ। তবু ফুটবলকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে তাঁকে যাঁরা মানা করেছিলেন শৈশব-কৈশোরে, বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছেও তাঁদের প্রতি ক্ষোভ নেই, ‘এটাই শুধু বলতে পারি, নিজের সামর্থ্য নিয়ে আমার কখনোই সংশয় ছিল না; তা অন্যরা যাই বলুক না কেন। এখন আমি যে পর্যায়ে এসেছি, সেখানে আসার বিশ্বাস সব সময় ছিল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আমাকে এখানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। অন্যদের কথাগুলো আমার জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। আমি দেখিয়েছি, ফুটবল খেলার জন্য আপনাকে শারীরিকভাবে গাট্টাগোট্টা হওয়ার প্রয়োজন নেই।’

লিকলিকে শরীর নিয়েই ক্যারিয়ারের এতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন মডরিচ। বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠা তো স্বপ্ন ছাড়ানো অর্জন। আরেক ধাপ এগিয়ে শিরোপা জয় নয় কেন! সে স্বপ্ন দেখছেন ক্রোয়াট অধিনায়কও। তবে ওই মোক্ষে পৌঁছানোর জন্য সতীর্থদের কোন ভাষণে উদ্দীপিত করবেন, তা আর খোলাসা করেননি গণমাধ্যমের সামনে, ‘জানি না, ফাইনালের আগে সতীর্থদের কী বলব। ওই মুহূর্তে যা মনে আসে, তাই বলব। তা নিয়ে এখনো ভাবিনি। আর আমি এর খসড়াও করে নিয়ে যাব না। আমাদের ফাইনালে মনোযোগ দিতে হবে; এত দিন যেভাবে খেলেছি, তার চেয়েও বেশি চেষ্টা করতে হবে। সবাইকে খুশি করতে চাই; নিজেদেরও। আমি ঠিক জানি না, ফাইনালের আগে সতীর্থদের কী বলব। আর সত্যি বলতে, জানলেও তো এমন খোলাখুলি সবার সামনে বলতাম না।’

সতীর্থদের যা বলার, বলবেন তিনি। আর বাকি বিশ্বের সঙ্গে মডরিচের কথা হবে ফুটবলের ভাষায়। শিল্পীর সঙ্গে শিল্পের সখ্যের উদাহরণ হয়ে থাকে যা। জীবনের কত কঠিন ধাপ পেরিয়ে ফুটবলার হয়েছেন! বিশ্বকাপের কত কঠিন ধাপ পেরিয়ে ফাইনালে এসেছেন! এবার শেষ ধাপ পেরোনোর চ্যালেঞ্জ।

তাহলেই ক্রোয়েশিয়ার বিশ্বকাপ জয়! তাহলেই হয়তো লুকা মডরিচের ব্যালন ডি’অর জয়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *