‘আসুন দলমত নির্বিশেষে একটা দুর্বার আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হই’

Slider রাজনীতি

315784_177

সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ‘আইনের শাসন ও গণতন্ত্র’ শীর্ষক আলোচনায় কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি দেশে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।

দেশে আজ গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নেই উল্লেখ করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, আসুন দলমত নির্বিশেষে একটা দুর্বার আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হই। তারা বলেন, আইনের শাসনে দেশ চলছে না, চলছে পুলিশের শাসনে। দেশে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে জগাখিচুড়ি চলছে। এ অবস্থা যতদিন থাকবে, ততদিনে আমরা নিঃশেষ হয়ে যাবো।

তারা আরো বলেন, দেশে এত অন্যায় হচ্ছে অথচ আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আইনজীবী, সাংবাদিক, জনগণের সম্মতিতে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কেন হয় না। প্রকৃত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে দেশের সংবিধান থাকে না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও থাকে না। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আলোচনায় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আরো বলেন, এত বড় দুঃশাসন, অরাজকতা ও স্বৈরতন্ত্রের পর আমরা যদি সবাই এক হতে না পারি, তবে কোনো দিন জাতি আমাদের মা করবে না। এজন্য গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ফিরিয়ে আনতে সবাইকে মাঠে নামতে হবে। রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হবে।

সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত আইনের শাসন ও গণতন্ত্র শীর্ষক আলোচনায় গতকাল শুক্রবার প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তৃতা করেন অন্যতম সংবিধানপ্রণেতা ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি জয়নুল আবেদীনের সভাপতিত্বে সমিতির শামসুল হক চৌধুরী হলে অনুষ্ঠিত আলোচনায় বক্তৃতা করেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ, নাগরিক ঐকের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুর রেজ্জাক খান, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সাংবাদিক নেতা রুহুল আমীন গাজী, গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্ট বারের সহ-সভাপতি এম গোলাম মোস্তফা ও ড. মো: গোলাম রহমান ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম মাহবুবউদ্দিন খোকন, ঢাকা বারের সভাপতি গোলাম মোস্তফা খান, ঢাকা ট্যাক্সসেস বারের সভাপতি আব্দুল মতিন, অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সাধারণ সম্পাদক এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। এ ছাড়া আলোচনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের লিখিত বক্তব্য পাঠ করা হয়।

স্বৈরাচার কখনো চিরস্থায়ী হতে পারবে না : ড. কামাল হোসেন
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেছেন, স্বৈরাচার এখানে কখনো চিরস্থায়ী হতে পারবে না। নির্বাচন সুষ্ঠু হতে হবে। এই সংবিধান বহু মূল্য দিয়ে আমরা পেয়েছি। আপস করার কোনো অবকাশ নেই।
দলমত নির্বশেষে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আসুন দলমত নির্বিশেষে একটা দুর্বার আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হই। আমাদের সাহসী হতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে।

তিনি বলেন, আসুন, আমরা এটা নিশ্চিত করি যে, দলমত নির্বশেষে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। আমরা পাহারা দেই এবং বাইরে থেকেও দেখবেন সবাই বলবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে। জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করবে, সুশাসন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে, সংবিধানকে রা করবে।

সুষ্ঠু নির্বাচনের পে ঐক্যের ডাক দিয়ে তিনি বলেন, ঐক্যের ডাক আমরা দিয়ে রেখেছি। বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ অনেকেই আমরা সেই ডাক দিয়ে রেখেছি। আসেন সবাই। সাত দফা সেখানে দেয়া হয়েছে। সেেেত্র দফার সাত হতে পারে, আট হতে পারে। মূল কথাগুলো সবই আছে।

ড. কামাল হোসেন আরো বলেন, এরা বলেছিল ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর কিছু দিনের মধ্যে সবার সাথে আলোচনা করে একটা নির্বাচন করবে। নির্লজ্জভাবে এরপর এরা ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত চালিয়েছে। লজ্জা নাই, নীতি নাই, বিবেক নাই, কিছু নাই। এরা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেবে আর আমরা মেনে নেব? আর স্কোপ নাই। আসুন আমরা এটা নিশ্চিত করি, দলমত নির্বিশেষে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ল্েয আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। বাইরের জগৎ থেকেও সবাই এটাই বলছে। সেই নির্বাচন ২০১৪-এর মতো একটি নির্বাচন না, সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন আমরা চাই না। কী লজ্জার ব্যাপার বাইরে (বাইরে দেশ) থেকে চোখে আঙুল দিয়ে বলে দিচ্ছে, এরকম নির্বাচন দেবেন না, দেবেন সুষ্ঠু নির্বাচন। আমাদের এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। জনগণের পে প্রহরীর ভূমিকা সারাজীবন রেখে এসেছি এবারো প্রহরীর ভূমিকা রাখতে আপনারা এগিয়ে এসেছেন। জেলায় জেলায় ও সুপ্রিম কোর্ট বার সবাইকে সম্পৃক্ত করেন।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ আইনজীবী বলেন, যারা দুর্নীতি করে, রাজনীতির নামে অন্য জিনিস করে তাদের ব্যাপারে জনগণই রাষ্ট্র, দেশকে রা করবেন। আইনজীবীরা তাদের পাশে থাকবেন, বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। তিনি আরো বলেন, গণতন্ত্র ও জবাবদিহি যদি না থাকে তবে সুশাসন, আইনের শাসন থাকবে না। জবাবদিহি যদি না থাকে, পাইকারিভাবে চুরিচামারি হয়।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়া আন্দোলনকারী ছাত্রদের অভিনন্দন জানিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, ছাত্রদের সাথে আমাদের যোগাযোগ নেই। তবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাগ্রত হয়েছে। সরকার জেনে নিক, এই দেশে গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্র কেউ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। এটা আমার বিশ্বাস। এটা আমরা একবার না বহুবার প্রমাণ করেছি। দুঃখ লাগে যে, আজকে ৪৬ বছর পরে আবার আমাদের সেই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কথা বলতে হচ্ছে, প্রস্তুতিও নিতে হচ্ছে।

ড. কামাল হোসেন বলেন, সুপ্রিম কোর্টের অবদান ভুলে গেলে চলবে না। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা হলো আইনজীবীদের আন্দোলন। এরশাদবিরোধী আন্দোলন। আমরা জেলায় জেলায় গিয়েছি। সবার ধারণা, আইনজীবীরা নিজেদের আয় ছাড়া কিছু বোঝে না। অন্তত বাংলাদেশের আইনজীবীরা একবার না বহুবার প্রমাণ করেছেন, দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিবেককে জাগ্রত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার ব্যাপারে, আন্দোলন করার ব্যাপারে আইনজীবীরা একটি অগ্রণী, প্রসংশনীয় ভূমিকা রেখেছেন।

তিনি বলেন, আমাদের অসাধারণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এর পূর্বশর্ত হলো সুশাসন, আইনের শাসন, গণতন্ত্র। কেননা, জবাবদিহি যদি না থাকে, যদি পাইকারিভাবে চুরিচামারি হয়, যদি দুই নাম্বারি কায়দায় কন্ট্রাক্ট দেয়া হয়, বিভিন্নভাবে সরকারের যে মতা এটা কোনো নীতির মধ্যে না থেকে দুর্নীতির মধ্যে চলে যায়, দুঃশাসনের মধ্যে চলে যায়, দলীয়করণের মধ্যে চলে যায়।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উনার মাত্র আড়াই মাস ছিল। কিন্তু উনাকে অপমান করে বিদায় দিলো। আমি মনে করি উনাকে না, এতে সারা জাতিকে অপমান করা হয়েছে। আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধানকে যারা অন্যায়ভাবে এটা করেছে তারা অসাংবিধানিক কাজ করেছেন। তাদের বিচার হতে হবে। আমরা বিচার করা ভুলে গেছি বলে এ অন্যায় বারবার হচ্ছে।

গণতন্ত্র-ভোটের অধিকার আদায়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : খন্দকার মাহবুব
প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, দেশে গণতন্ত্র কায়েম করতে হলে, মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। কোনো স্বৈরশাসকের অধীনে মানুষ ভোটের অধিকার পাবে না, গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার আদায়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
তিনি বলেন, কোনো স্বৈরশাসকের অধীনে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র থাকতে পারে না। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন কায়েমে আমাদের সবাইকে মাঠে নামতে হবে। রাজপথ উত্তপ্ত করতে হবে। গণতন্ত্র কায়েমের জন্য আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। তিনি আরো বলেন, ১৯৫৪ সালে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার আদায়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়েছিল। এখন আমাদের একটিমাত্র ইস্যু গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ফিরিয়ে আনা। এজন্য ড. কামাল হোসেন, বি. চৌধুরীসহ সবাইকে মাঠে নামতে হবে।

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, রাজনৈতিক নেতা ও রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে নিজস্ব অবস্থান বজায় রেখে ঐকবদ্ধ হতে হবে। রাজনৈতিক দলকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। দেশে আজ কী অবস্থা তা মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নেই এটা সেমিনার করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ড. কামলা হোসেন রাজপথে নামার যে ডাক দিয়েছেন রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোর তাতে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

দেশের গণতন্ত্রে ভেজাল : ডা: জাফরুল্লাহ
ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশের গণতন্ত্র তো ভেজাল। এখানে আইনের শাসন কিভাবে প্রতিষ্ঠা হবে। যেখানে গণতন্ত্র ভেজাল সেখানে আইনের শাসন সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, আজকের ভেজাল গণতন্ত্রের জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের ভূমিকা ছিল। তার বিচার কি কোনো দিন হবে? ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী আরো বলেন, আজকে ভেজাল গণতন্ত্রের কারণে ড. কামাল হোসেন, বি. চৌধুরীরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। ভেজালমুক্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তিনি ড. কামাল হোসেন ও সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান জানান।

ভয়-ভীতির মধ্যে বসবাস সুশাসন নয় : মইনুল হোসেন
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন লিখিত বক্তব্যে বলেন, ভয়-ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করাকে স্বাধীনতা কিংবা সুশাসন বলা যাবে না। স্বাধীন দেশে অবাধ নির্বাচন হতে না দেয়ার অর্থ জনগণের স্বাধীনতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। তিনি বলেন, আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে এবং রাষ্ট্রপতি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পরামর্শ করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করবেন।

ভীতির চাদর বিছানো হয়েছে : মাহফুজ উল্লাহ
মাহফুজ উল্লাহ বলেন, আজকে একটা ভীতির পর্দা সারা দেশের ওপর দিয়ে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। আতঙ্কে কেউ কথা বলছে না। পুরো সমাজ যখন ভীতিগ্রস্ত করা হয়। সমাজকে যখন ভীতি গ্রাস করে তখন গণতন্ত্র ও আইনের শাসন অনেকখানি অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই ভীতির যে চাদর বিছানো হয়েছে এজন্য আদালত, প্রশাসন ও মতাসীন রাজনৈতিক দল দায়ী। দেশে উদ্বেগের কারণে প্রতিহিংসার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দেশে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা দেখি না। বর্তমান সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করবে; ততক্ষণ পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে জেল থেকে ছাড়বে না। খালেদা জিয়া ১৯৮৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত গণতন্ত্রের জন্য লড়ছেন।

দেশে আইনের শাসন নাই : মান্না
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, দেশে আইনের শাসন নাই। আইনের শাসন যে নাই; সেটার প্রতিফলন করার জন্য যাদের হাতে মতা আছে তারা আইন অমান্য করার মতা রাখে। যারা আইনের পে কথা বলবেন তিনি যদি আইন বিভাগের সর্বোচ্চ ব্যক্তিও হন তাকে কান ধরে ঘাড় ধরে বের করে দিতে হবে। কিছুই করতে পারবেন না। তিনি বলেন, আইনের শাসন কি ৫৭ বা ৩২ ধারা না ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আইনের শাসন যদি থাকত তাহলে এমন একটি মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার সাজা হতো না।

তিনি আরো বলেন, বেগম খালেদা জিয়া জেলে আছেন সেটা অন্যায়। তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না- এটাও অন্যায়। তিনি আরো বলেন, দেশের ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা লুট হয়েছে। সেখানে দুই কোটি টাকা বেড়ে ৬ কোটি টাকা হওয়ার পরও খালেদা জিয়ার সাজা হয় কিভাবে? এই আইনের শাসনে সাজা দেয়া হয়েছে এবং জামিন দেয়া হচ্ছে না।
মান্না বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ফ্রড, ৪২০ নম্বর নির্বাচন। তিনি বলেন, রাজপথে নামতে হবে। যেমন করে ছাত্ররা কোটা সংস্কারের আন্দোলন করেছেন। তিনি বলেন, আমরা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই; এজন্য রাজপথে আন্দোলন করতে হবে। ওই মিছিলের সামনে থাকবেন ড. কামাল হোসেন ও বি. চৌধুরী।

বড় দুঃশাসন, অরাজকতা : আসিফ নজরুল
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আইনের শাসন বলতে তিনটি বিষয় বোঝানো হয়। এক. দেশ চলবে আইন অনুসারে এবং আইন প্রয়োগ হবে সমানভাবে। কিন্তু আমরা যে আইনের শাসন দেখি সেখানে, গুম, ক্রস ফায়ার এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক লুটেরও বিচার দেখি না। তাহলে এখানে আইন কিভাবে প্রয়োগ হচ্ছে? দুই. জনস্বার্থে আইন করতে হবে। কিন্তু আইসিটি অ্যাক্ট, স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট কিভাবে হয়? তিন. জনগণের সম্মতিতে আইন প্রণয়ন করতে হবে। সেেেত্র জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিদের দ্বারা আইন প্রণয়ন করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, দেশে এত অন্যায় হচ্ছে অথচ আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আইনজীবী, সাংবাদিক, জনগণের সম্মতিতে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কেন হয় না, তা আমি বুঝি না। প্রকৃত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে দেশের সংবিধান থাকে না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা তাও থাকে না। কেননা, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে চেতনা হচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এত বড় দুঃশাসন, অরাজকতা ও স্বৈরতন্ত্রের পর আমরা যদি সবাই এক হতে না পারি, তবে কোনোদিন জাতি আমাদের মা করবে না।

আসিফ নজরুল আরো বলেন, কোনো সরকারের আমলে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। আমি রাজনীতিবিদদের কথা বাদই দিলাম। এই সরকারের আমলে আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, আইসিটি, মানহানি ও আদালত অবমাননার মামলা হয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে এক ধরনের মামলার প্রয়োগ, আর ব্যাংক লুটেরা, খুনি, ধর্ষণকারী তাদের বিরুদ্ধে আরেক রকমের আইনের প্রয়োগ হতে পারে না।

তিনি বলেন, জননেত্রী পরিষদ নামে একটি সংগঠনের নেতা উনি খালেদা জিয়া, বিএনপি ও বিরোধী দলের বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেন, ইন্টারভিউ দিয়ে বলেছেন তিনি এগুলো করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। একটা ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য। এ সংবাদ প্রথম আলোতে ছাপা হওয়ার পরও খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে মামলা আমলে নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, আমার খুবই দুঃখ লাগে এর চেয়েও কম দুঃশাসন যখন দেশে ছিল, এর চেয়েও কম অরাজকতা যখন ছিল তখন সমস্ত জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেছে। আজকে কত রকম অন্যায় হচ্ছে। কেন আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আইনজীবী নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিকেরা সবাই মিলে জনগণের ভোটে জনগণের সম্মতিতে একটা সরকার গঠনে এ আন্দোলনটা হয় না কেন; কিছুই বুঝি না! আর কত সর্বনাশ আমাদের দেখতে হবে?

অবস্থা আরো খারাপ হবে : ড. শাহদীন মালিক
ড. শাহদীন মালিক বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে দেশে সাংবিধানিক আইনের শাসন শুরু। ’৭৩ সাল থেকে বিচ্যুতি শুরু হয়। আর এখন নি¤œমুখী অবস্থায় যেতে যেতে তলানিতে ঠেকেছে। বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী পেশাজীবীদের লেজুড়বৃত্তি। আজ সমাজ বিভক্ত। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে এই বিভাজন। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে পেশাজীবীদের লেজুড়বৃত্তি ছাড়তে হবে।

তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর সারা দেশে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি মানুষের যে আস্থা ছিল তার ৭০ ভাগ আস্থা চলে গেছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের আইন হয়নি। তিনি বলেন, দুনিয়ায় এমন ডিভাইডেড দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। এমন বিভাজিত হওয়ায় দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব হয় না, আইনের শাসন থাকে না এবং এর থেকে অবস্থা আরো খারাপ হবে। তাই লেজুরবৃত্তি কমিয়ে আনতে পারলে আমরা আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের পথে আবার নতুন করে যাত্রা শুরু করতে পারব।

সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, দেশের নি¤œ আদালত সরকার ও সরকারি প্রশাসন কবজা করে ফেলেছে। সুপ্রিম কোর্টে মনে হচ্ছে সরকারের করায়ত্বে চলে যাচ্ছে। এদেশের মানুষ সুপ্রিম কোর্টের প্রতি বিগত দিনের মতো আস্থা রাখতে পারছেন না। খালেদা জিয়াকে হাইকোর্ট থেকে জামিন দেয়ার পরও সুপ্রিম কোর্ট তা স্থগিত করেছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে বিদায় করার পর সব বিচারকই ভীত। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আমরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে যাব। দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনব।

ইশারা ছাড়া দেশে একটি পাতাও নড়ে না : সুব্রত চৌধুরী
সুব্রত চৌধুরী বলেন, একজনের ইশারা ছাড়া বাংলাদেশের একটি পাতাও নড়ে না। আমরা এখন এই অবস্থার মধ্যে আছি। আর আইনের শাসন তো সুদূর পরাহত। এখন আর আইনের শাসনে দেশ চলছে না, দেশ চলছে পুলিশের শাসনে। দেশে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে জগাখিচুড়ি চলছে। এ অবস্থা যতদিন থাকবে ততদিনে আমরা নিঃশেষ হয়ে যাবো। কিন্তু আমরা তো নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার জাতি না। বাঙালি জাতি কখনো নিঃশেষ হবে না। সবকিছু মোকাবেলা করে আমরা এগিয়ে যাবো। এজন্য তিনি দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, দেশের সর্বত্র দলীয়করণের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। আইনের শাসন নেই। গণতন্ত্রও চলে গেছে। তিনি বলেন, ভয়ভীতি ও নিরাপত্তহীনতার মধ্যে বাস করাকে সুশাসন বলা যাবে না। তিনি আরো বলেন, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পদত্যাগের পর বিচার বিভাগ ইউটার্ন নেয়। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচার বিভাগ যে আলোর মুখ দেখেছিল তা ভূলুষ্ঠিত হতে চলেছে। উচ্চ আদালত থেকে নিম্ন আদালতের বিচারকেরা আতঙ্কে রয়েছেন। সরকারের বিরুদ্ধে রায় হলে তাদের অবস্থাও এস কে সিনহার মতো হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *