ঢাকা: সব সময় সব ফসল ফলে না। সব কাজও সব সময় করা যায় না। এমনকি একই কাজ থেকে সময়ভেদে ফলও পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন। তাই সব কাজের জন্যই চাই যথাযথ সময়। ইবাদতের জন্যও এটা দরকার। সেই সময়গুলো হিসাব কষে বের করার মতো বিষয় নয়। তা জানা সম্ভব ছিল না কোনো মানুষের পক্ষে যদি না আল্লাহ তায়ালা দয়া করে তা জানাতেন। ইবাদতের তেমন বিশেষ সময় রয়েছে প্রতিটি দিন ও সপ্তাহের মধ্যেও। আছে ইবাদতের বিশেষ মাস, প্রতি মাসের মধ্যে রয়েছে বিশেষ বিশেষ দিনও। এই সময়গুলো কম-বেশি সবারই জানা; সবাই পরিচিত এগুলোর সাথে কোনো না কোনোভাবে।
এমন দিন-রজনীভিত্তিক বিশেষ ইবাদতগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো পবিত্র লাইলাতুল কদরের ইবাদত। এটা উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য বিশেষ। আগের কোনো উম্মতের জন্য ছিল না এ সুযোগ। এই রাতের গুরুত্ব এতই বেশি যে, এ জন্য আল্লাহ পাক নাজিল করেছেন আল কুরআনের পুরো একটি সূরা এবং নবী সা: স্বয়ং এর নির্দিষ্ট সময় খুঁজে বের করে দিয়ে গেছেন তাঁর প্রিয় উম্মতের জন্য। রমজানের শেষ ১০ দিনের মধ্য থেকে খুঁজে নিতে বলা হয়েছে মহিমান্বিত এ রাতকে। ১০ দিনের মধ্যে একে লুকিয়ে রেখে আল্লাহপাক বস্তুত তাঁর প্রকৃত বান্দাদের জন্য নিশ্চিত করেছেন সর্বোচ্চ রহমত ও বরকত লাভের ব্যবস্থা। তবে এত গুরুত্বের পরও লায়লাতুল কদরের ইবাদতকে ফরজ করা হয়নি। বস্তুত, আল্লাহ অপরিহার্য তাঁর কোনো বিশেষ ইবাদতকেই মানুষের জন্য আবশ্যক করেননি, বরং ছেড়ে দিয়েছেন তাদের ইচ্ছার ওপর। ফলে এ ইবাদতগুলো থেকে লাভবান হতে পারেন শুধু আল্লাহ পাকের ঘনিষ্ঠ ও একনিষ্ঠ বান্দারা।
দিবস ও রজনীভিত্তিক বিশেষ ইবাদতগুলোর মধ্যে আরো আছে আশুরা, আরাফার দিন ও পবিত্র শবেবরাতের ইবাদত। অবশ্য বিতর্কও রয়েছে শবেবরাত নিয়ে। আয়েশা রা:-এর সূত্রে বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থ ইবনে মাজাহ শরিফে এর বিবরণ থাকার পরও এ ব্যাপারে বিতর্ক বড়ই দুর্ভাগ্যজনক এবং অগ্রহণযোগ্য। প্রথমত, এমন প্রতিষ্ঠিত হাদিস গ্রন্থের সামান্য একটি বাক্যও যেখানে চ্যালেঞ্জ করার যোগ্যতা রাখেন না এ যুগের কেউই, সেখানে পুরো একটি হাদিসকে বাতিল বলে গণ্য করা বিরাট অন্যায়। তদুপরি হজরত আয়েশা রা: ছাড়াও এর সপক্ষে আরো প্রায় ১০ জন সাহাবির বর্ণনা রয়েছে অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে এবং রয়েছে অনেক পরোক্ষ নির্দেশনাও। তাই এর গুরুত্ব অস্বীকার করা অযৌক্তিক।
উল্লেখ্য, ১৫ শাবান হলো আইয়ামে বিজের একটি দিন, প্রতি মাসের এ দিনগুলোতে নিয়মিত রোজা রেখেছেন নবী করিম সা:। উপরন্তু এটা শাবান মাসের ‘আইয়ামে বিজ’ হওয়ায় তা বাড়তি গুরুত্বের দাবি রাখে। কারণ রমজানের বাইরে এই মাসেই সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতেন নবী সা: মাহে রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে। এ কাজ তিনি তাঁর উম্মতকেও করতে বলেছেন। একই সাথে শাবানের শেষ ১৫ দিন রোজা না রাখতে বলেছেন রমজানের জন্য শক্তি সংরক্ষণের প্রয়োজনে। এসবই নবী সা:-এর অতিপ্রসিদ্ধ নির্দেশনা, যা গভীর শ্রদ্ধার সাথে অনুশীলন করে থাকে বিশ্বমুসলিম। বিষয়গুলো একসাথে বিবেচনা করলে ১৫ তারিখের বিশেষত্ব আঁচ করা যায় সহজেই এবং এ সংক্রান্ত হাদিসগুলোকে তখন ভিত্তিহীন বলে মনে হয় না। বরং শাবানে রোজা রেখে রমজানের অনুশীলন করতে হলে লাইলাতুল কদরের মতো বিশাল রজনীর জন্যেও শাবান মাসে ছোটখাটো অনুশীলনের ব্যবস্থা থাকাটা মোটেও অযৌক্তিক নয়। তাই শবেবরাতের ইবাদতকে নাকচ করার চেষ্টা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
সম্প্রতি এক শবেবরাতের রাতে হঠাৎ আলহামদুলিল্লাহ, স্বপ্নে দেখেছি মহানবী সা: মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আলাপ করছেন হজরত ওমর রা:-এর সাথে। স্বপ্নটা ছিল আমার প্রতি পরম করুণাময় আল্লাহ পাকের বিশেষ দয়া। এর অর্থ ছিল পরিষ্কার, আমার মতে, লায়লাতুল বরাতের সত্যায়ন (Approval)। এমন স্বপ্ন দেখার মতো পুণ্য স্মরণ করতে পারি না। হয়তো বাড়তি ইবাদতের প্রতি আমার তীব্র আগ্রহ আল্লাহ পাক পছন্দ করে থাকবেন। তবে ঘটনাটি একান্তই ব্যক্তিগত, ধারণা করা যায়, এমন ব্যক্তিগত দলিল অবশ্যই আছে আল্লাহ পাকের আরো অনেক বান্দার কাছে এবং সেগুলো সব একত্র করতে পারলে লাইলাতুল বরাতের প্রমাণ আরো শক্তিশালীই হবে নিঃসন্দেহে।
এ দিনের হালুয়া-রুটিকেন্দ্রিক হৈ-হুল্লোড় বস্তুত একটি লোকাল কালচার তথা আঞ্চলিক সংস্কৃতি বিশেষ। এর সাথে পবিত্র শবেবরাতের ধর্মীয় গুরুত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। আল্লাহর ওয়াস্তে মানুষকে খাওয়ানো ইসলামিক কালচারেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বছরের যেকোনো সময়ই কাজটা করা যায় এবং সেটা খুবই সওয়াবের কাজ। তবে তা হালুয়া-রুটি দিয়েই করতে হবে, তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আবার কেউ তা করতে চাইলে বাধা দেয়ারও কিছু নেই। সেটা পুরোপুরিই দাতার সামর্থ্য ও নিয়তের বিষয়। অঞ্চলভেদে মিষ্টি, খিচুড়ি কিংবা খেজুর তথা সুবিধামতো যেকোনো খাবারই বিশেষ করে গরিব মানুষকে দান করা যায়। সুবিধামতো দান-খয়রাত করাই ইসলামের নীতি। যেকোনো বাড়াবাড়ি আসলে ইবাদতের পথে বাধাবিশেষ, ইবাদতের দৃঢ় নিয়তই পারে অযাচিত বিচ্যুতি থেকে আমাদের রক্ষা করতে।
মঈনুল আহসান
লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী