হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের চাঞ্চল্যকর বিউটি হত্যা মামলার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। মামলার বাদী বিউটির বাবা ছায়েদ আলী শনিবার পাঁচ ঘণ্টার জবানবন্দিতে নিজেই অকপটে স্বীকার করে নিলেন মেয়ে হত্যার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
হত্যার রাতে নিজেই নানার বাড়ি থেকে নিয়ে এসে বিউটিকে তুলে দিয়েছেন খুনিদের হাতে। ধর্ষণকারী বাবুল নয়, মামলার সাক্ষী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ময়নাই বিউটির হত্যাকারী। ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বরাত দিয়ে এমন তথ্যই নিশ্চিত করেছেন হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
শনিবার বিকালে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ব্রিফিংকালে পুলিশ সুপার জানান, গ্রাম্য রাজনীতির বলি হয়েছেন বিউটি। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে রংপুরের আইনজীবী হত্যাকাণ্ডের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে।
স্বাধীনতার মাস মার্চে লাল-সবুজের পতাকায় বিউটির হত্যা নিয়ে যে পোস্টটি সারা দেশে ভাইরাল হয়, তদন্তে এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র পাওয়া গেছে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো কিছু ভাইরাল হলে মামলা ও তদন্তে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে।
আলোচিত কিশোরী বিউটি হত্যা মামলার বাদী বিউটির বাবা ছায়েদ আলী আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত হবিগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের আদালতে ছায়েদ আলী এ জবানবন্দি দেন। পরে প্রতিবেশী ময়না মিয়ার স্ত্রী আছমা আক্তারের বক্তব্যও রেকর্ড করে আদালত।
প্রথম দফায় দায়ের করা ধর্ষণ মামলার সাক্ষী বিউটির চাচা ময়না মিয়াকে বৃহস্পতিবার আটক করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এসব জিজ্ঞাসাবাদেই বেরিয়ে আসে নতুন তথ্য। শেষ পর্যন্ত ময়না মিয়া শুক্রবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডে নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। প্রকাশ করেন জড়িত অন্যদের নাম।
হত্যার ঘটনায় বিউটির নানী ফাতেমা বেগম সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এরপর শুক্রবার রাতে একই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন গ্রেফতার বাবুল মিয়া। তিনি প্রথম দফায় বিউটিকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। তবে হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতা নেই বলে আদালতকে জানিয়েছেন বাবুল।
অন্যদিকে, বাবুলের মা ইউপি সদস্য কলমচান বিবিকে দুই দিনের রিমান্ড শেষে শুক্রবার রাতে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বিউটির মা হুসনে আরা ও ভাই সাদেক মিয়া পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন।
পুলিশ সুপার বলেন, বিউটিকে ধর্ষণকারী বাবুল মিয়া অলিপুরে প্রাণ কোম্পানিতে সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি করত। তার মা বিগত ইউপি নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী সদস্য নির্বাচিত হন। ফলে এলাকায় তার অর্থ ও প্রভাব রয়েছে। একই এলাকার ছায়েদ মিয়ার মেয়ে বিউটি আক্তার স্থানীয় মোজাহের উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। বাবুলের কুদৃষ্টি পড়ে তার ওপর।
বিউটির সাথে প্রেমের সম্পর্ক করে তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখায় সে। অলিপুর এলাকায় এক হাজার টাকায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত বিউটিকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করে বাবুল। ৯ ফেব্রুয়ারি বিউটিকে প্রাণ কোম্পানিতে চাকরি দেবে বলে সেখানে নিয়ে যায়।
খবরটি জানতে পারেন পাশেই আরএফএলের ফ্যাক্টরিতে চাকরি করা বিউটির মা হুসনে আরা। তিনি এবং বিউটির বাবা ছায়েদ আলী প্রাণ কোম্পানিতে গিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করেন। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকায় শালিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাবুল বিউটিকে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় শালিসে কোনো সমাধান হয়নি। পরে বিউটিকে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে তিন দিন রাখা হয়।
১৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে অপহরণসহ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন বিউটির বাবা ছায়েদ আলী। ৪ মার্চ শায়েস্তাগঞ্জ থানায় মামলাটি এফআইআর হিসেবে নথিভুক্ত হয়। ১২ মার্চ বিউটিকে থানায় আনা হয়। পরে মেডিকেল পরীক্ষা করার পর আদালতে বিউটি জবানবন্দি দেয়। বাবুল তাকে বিয়ে করলে মামলা তুলে নেবে বলেও সেখানে জানায় বিউটি।
বিউটিকে বাড়িতে আনার পর দিশাহারা হয়ে পড়েন বাবা ছায়েদ আলী। বাড়িতে মেয়েকে না রেখে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লাখাই উপজেলার গুণীপুর গ্রামে নানী ফাতেমা বেগমের বাড়িতে। এ সুযোগে নতুন করে ফন্দি আঁটেন বিউটির দূরসম্পর্কের চাচা ময়না মিয়া। বিগত ইউপি নির্বাচনে ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সংরক্ষিত নারী আসনের মেম্বার পদে নির্বাচনে অংশ নেন আওয়ামী লীগ নেতা ময়না মিয়ার স্ত্রী আছমা আক্তার ও বাবুলের মা কলমচান বিবি। কথা ছিল কলমচান নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আছমা আক্তারকে ছাড় দেবেন। শেষ পর্যন্ত কথা না রেখে কলমচান নির্বাচনে অংশ নেন এবং তার কাছে পরাজিত হন ময়না মিয়ার স্ত্রী আছমা আক্তার। এরই জের ধরে বিউটিকে অপহরণের পর ধর্ষণের ঘটনায় মামলায় সাক্ষী হন আওয়ামী লীগ নেতা ময়না মিয়া। মামলায় আসামি করা হয় কলমচান বিবি ও তার ছেলে বাবুল মিয়াকে। ছায়েদ আলীকে ময়না মিয়া প্রায়ই বোঝাতে থাকেন, বাবুল যদি বিউটিকে বিয়ে না করে তাহলে এই নষ্ট মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না।
অন্য সন্তানদেরও আর বিয়ে হবে না। এর চেয়ে যদি বিউটিকে মেরে বাবুল মিয়া ও তার মা কলমচান বিবিকে ফাঁসানো হয়, তাহলে প্রতিশোধও নেওয়া হবে, তার অন্য সন্তানরা রক্ষা পাবে। একপর্যায়ে ময়না মিয়ার ফাঁদে পা দেন ছায়েদ আলী। ময়না মিয়া ১০ হাজার টাকায় একজন পেশাদার খুনিকে ভাড়া করে আড়াই হাজার টাকা অগ্রিম প্রদান করেন। পরে ঘটনার দিন রাতে ছায়েদ আলী, বাবুল মিয়া ও ভাড়াটে খুনি গুণীপুর গ্রামে যান।
শাশুড়ি ফাতেমা বেগমকে ছায়েদ আলী বলেন, বিউটিকে চেয়ারম্যানের কাছে নেওয়ার জন্য তিনি এসেছেন। পরে লাখাই উপজেলার হরিণাকোণ গ্রামে রাত ২টার দিকে বিউটিকে হত্যা করা হয়। ভাড়াটে লোক বিউটির হাত-পা বেঁধে ধরে রাখেন আর ময়না মিয়া ছুরি দিয়ে পাঁচটি আঘাত করে হত্যা করেন বিউটিকে। পরে রক্ত ধুয়ে লাশটি হাওরে ফেলে রাখা হয়। লাশ পাওয়ার খবর শুনে বিউটির বাড়িতে নানী ফাতেমা বেগম এলে তাকে শাসিয়ে দেওয়া হয় কোনো কিছু না বলার জন্য।
পুলিশ সুপার জানান, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ছায়েদ আলী ও ময়না মিয়ার গুণীপুর গ্রামে উপস্থিতির প্রমাণ পান তারা। এ ছাড়া আচরণে সন্দেহ হলে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। ভাড়াটে খুনিকে ধরতে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলে আরও তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, বাবুল মিয়া সরাসরি হত্যায় জড়িত না থাকলেও তার কারণেই যেহেতু এ ঘটনা ঘটেছে, তাই অবশ্যই তাকে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে মামলার অভিযোগপত্রে রাখা হবে।
উল্লেখ্য, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের বিউটি আক্তার (১৬) গত ১৬ মার্চ রাতে নানীর বাড়ি গুণীপুর গ্রাম থেকে নিখোঁজ হয়। পরদিন গুণীপুর গ্রাম থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে শায়েস্তাগঞ্জের হাওরে তার লাশ পাওয়া যায়। এ সময় তার শরীরের একাধিক স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ ঘটনায় ১৮ মার্চ বিউটির বাবা ছায়েদ আলী বাদী হয়ে শায়েস্তাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন। এখন তিনি নিজেই ওই মামলায় আসামি।