দীর্ঘদিন ধরে বড় ধরনের জনসভার অনুমতি পাচ্ছে না বিএনপি। বিশেষ করে ঢাকায় পাচ্ছে না কোনো ধরনের সভা-সমাবেশের অনুমতি। কর্মসূচি ঘোষণা দিলেই বাধার মুখে পড়ছে দলটি। অনুমতি নিয়ে কয়েক ঘণ্টার অবস্থান বা মাননববন্ধন কর্মসূচি করলেও তা নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিয়ে কৌশলে সামনে এগোতে চাইছে বিএনপির হাইকমান্ড। এর আগে সর্বশেষ গত বছরের ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে সমাবেশ করেছিল দলটি। সেই হিসেবে গত ৫ মাসে মাত্র একটি জনসভা করেছে বিএনপি। ঢাকায় একটি জনসভার জন্য ইতোমধ্যে চারবার অনুমতি চেয়েও তা মেলেনি। সর্বশেষ গতকাল (২৯ মার্চ) ঢাকায় জনসভা করতে চেয়েছিল বিএনপি। এ ব্যাপারে দলটির তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে গত মঙ্গলবার দেখা করেন। কিন্তু অনুমতি না মেলায় ঢাকার জনসভার স্থগিত করেছে বিএনপির হাইকমান্ড।
এ দিকে দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আজ ৫০ দিন ধরে কারাবন্দী। তার মুক্তির দাবিতে দীর্ঘ এই সময়ে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। এ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক হবে বলে বিএনপি যে ঘোষণা দিয়েছিল সে কথাও রেখেছে দলটি। তবে বিএনপির কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ হলেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিয়েছে এবং মারমুখীও ছিল।
উল্লেখ্য, গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সাজা দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। ওই দিন থেকেই তিনি পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রয়েছেন।
২০১৫ সালের শুরুতে টানা তিন মাস হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করলেও তারপর থেকে দৃশ্যত কোনো বড় আন্দোলন করেনি দলটি। দীর্ঘ এ সময়ে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে কিছু সভা-সমাবেশ করে ঘরোয়াভাবে। কিন্তু প্রকাশ্যে মাঠে কোনো সমাবেশ করতে গেলেই অনুমতি পায় না বিএনপি। দলটির কর্মসূচি ঘিরে এক ধরনের বিধিনিষেধ চলছে।
বিগত দিনগুলোতে দিবসভিত্তিক শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েও অনুমতি পায়নি। ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করেছিল বিএনপি। এরপর থেকে ঢাকায় আর কোনো জনসভার অনুমতি পায়নি দলটি।
দলীয় সূত্র মতে, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কৌশলগত কারণে আপাতত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখলেও পরিস্থিতি বুঝে অন্য কৌশলে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। দলটির নেতাকর্মীদের বিশ্বাস, আইনি লড়াই ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব। গত ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দী হওয়ার পর দলীয় প্রধানের মুক্তির দাবিতে ঢাকায় বিএনপির পাঁচ দিনের কর্মসূচি পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়ে যায়। ঢাকায় সমাবেশ করার জন্য চার দফা স্থান বরাদ্দ চেয়েও অনুমতি পায়নি দলটি। ঢাকার বাইরেও সমাবেশের অনুমতি নিয়ে প্রশাসন গড়িমসি করছে বলে সংশ্লিষ্ট নেতারা জানিয়েছেন।
জানা যায়, ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর দিন গত ৯ ফেব্রুয়ারি বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর ফটক থেকে বিােভ শুরু করে বিএনপি। ১০ ফেব্রুয়ারি ফের বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর ফটক থেকে বিােভ মিছিলটি দৈনিক বাংলা মোড় অতিক্রম করে ফকিরাপুল পানির ট্যাংকের কাছে যেতে না যেতে পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়ে যায়। গত ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস কাবের সামনে মানববন্ধন, ১৩ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি, ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস কাবের সামনে অনশন কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। ধরাবাহিক কর্মসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন এনে ১৭ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টন কার্যালয় থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে গণস্বার সংগ্রহ কর্মসূচি শুরু করে। যা এখনো চলমান।
১৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হয়, ২০ ফেব্রুয়ারি ফের বিােভ কর্মসূচি পালন করা হয়। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগেই পুলিশি বাধায় তা পণ্ড হয়ে যায়। জলকামানের রঙিন পানির আক্রমণে আহত হন অনেক নেতাকর্মী। গ্রেফতার করা হয় অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও পানির ছিটায় ভিজে যান। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ডাকা কর্মসূচিগুলোর মধ্যে ওই দিন হঠাৎ পুলিশ নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয়। এতে বহু নারীনেত্রী আহত ও গ্রেফতার হন। কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচিতে বাধা দেয়ার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার ঘোষণা দিলেও অনুমতি না দেয়ার প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার থানায় থানায় প্রতিবাদী মিছিল কর্মসূচি পালন করা হয়।
এরপর ১ মার্চ সারা দেশে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি। সে দিন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের ব্যাপক তৎপরতার কারণে কেন্দ্রীয় নেতারা কার্যালয়ের সামনের সড়কে লিফলেট দিয়ে দ্রুত চলে যান। ৬ মার্চ জাতীয় প্রেস কাবের সামনে মানববন্ধন করা হয়। সে দিন কর্মসূচির শেষ দিকে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবুকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে প্রেস কাব প্রাঙ্গণ থেকে আটক করে। এ ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। গত ৮ মার্চ সারা দেশে এক ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি ছিল বিএনপির। ঢাকায় জাতীয় প্রেস কাবের সামনে বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ কর্মসূচিও শেষ মুহূর্তে পুলিশের বাধায় পণ্ড হয়ে যায়। সে দিন জাতীয় প্রেস কাবের সামনে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি থেকে ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি এস এম মিজানুর রহমান রাজকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কোল থেকে টেনেহিঁচড়ে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এসব কর্মসূচি সারা দেশেও পালিত হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশি বাধার মুখে কর্মসূচি পণ্ড হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ তৎপরতা চালিয়েছে বিএনপি। ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকদের চলমান পরিস্থিতি অবহিত করার পাশাপাশি জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্রের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার অনুমতি না পাওয়ায় প্রথমে ১২ মার্চ, পরে ১১ মার্চ জনসভা করার ঘোষণা দেয় বিএনপি। কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় ফের ১৯ মার্চ জনসভার জন্য আবেদন করে দলটি। ওই দিনও অনুমতি না পাওয়ায় ফের ২৯ মার্চ জনসভার জন্য আবেদন করে। এ ব্যাপারে গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে দেখা করে কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। তবুও জনসভার অনুমতি পায়নি বিএনপি। এ ছাড়া ১০ মার্চ খুলনার হাদিস পার্কে এবং ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে জনসভা করতে চাইলেও অনুমতি পায়নি দলটি। ফলে শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে দলীয় কার্যালয়ের সামনেই সভা করতে হয়েছে।
এর বাইরে কয়েক দফা তারিখ পরিবর্তন করে আগামী ৭ এপ্রিল বরিশাল, ১০ এপ্রিল সিলেট এবং ১৫ এপ্রিল রাজশাহীতে জনভার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এ ধরনের সভা অন্যান্য বিভাগীয় শহরেও করা হবে। অনুমতি না পেলেও এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে সার্বিক প্রস্তুতি বিএনপির রয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
এ ব্যাপারে কথা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের সাথে। তিনি সরকারের কাছে প্রশ্ন রেখে নয়া দিগন্তকে বলেন, মতাসীন আওয়ামী লীগ শুধু নয়, বিরোধী জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি যেখানে সমাবেশ করছে, সেখানে বিএনপিকে সমাবেশ করতে বাধা দেয়া হচ্ছে কেন? আমরা তো শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচি চালিয়ে আসছি। কারণ এ সরকার জনগণকে ভয় পায়। তারা জানে বিএনপির জনসভায় লাখ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করেন। যেটা সরকারি দলের জন্য লজ্জার ব্যাপার। কেননা তাদের জনসভায় বাধ্য করেও লোক যায় না। কিন্তু আমরা প্রত্যাশা করি সরকারের সুমতি হবে, তারা আমাদের কর্মসূচির অনুমতি দেবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপি যথাসময়ে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক বিকল্প কর্মসূচি দেবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়া দিগন্তকে বলেন, এ সরকারবিরোধী দলকে দমনের জন্য কোমর বেঁধে লেগেছে। তারা গণতন্ত্রের ন্যূনতম গন্ধও সহ্য করতে পারছে না। আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চালিয়ে আসছি। কিন্তু সরকারই উসকানি দিয়ে তাদের সাজানো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে তা ভণ্ডুল করে দিচ্ছে। বারবার আবেদন করেও ঢাকায় এখন পর্যন্ত জনসভার অনুমতি দিচ্ছে না। তবে আমরা প্রত্যাশা করি সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং আমাদের জনসভার অনুমতি দেবে।