খালেদা জিয়ার ৫ বছর ও তারেকের ১০ বছরের কারাদন্ড

Slider জাতীয় সারাদেশ

download

 

 

 

 

 

ঢাকা: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

রাজধানীর বকশীবাজারস্থ আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার ৫ম বিশেষ জজ আদালতে বিচারক ড. আখতারুজ্জামান এ রায় ঘোষণা করছেন।

আদালতে খালেদা জিয়া
এর আগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় রায় শুনতে আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১টা ৪৮ মিনিটে আদালতে হাজির হন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।

খালেদা জিয়ার সাথে আদালতে প্রবেশ করতে পেরেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম. হাফিজ উদ্দিন ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।

এর আগে গুলশানের বাসা থেকে ১১টা ৪৫ মিনিটে আদালতের উদ্দেশে রওনা দেন খালেদা জিয়া। আদালতের পথে রওয়ানা দেবার পর তার গাড়িবহরে হাজার হাজার নেতা-কর্মী যোগ দেয়। মগবাজার মোড়ে তার গাড়িবহর পৌঁছার পর নেতা-কর্মীদের ঢল নামে।

খালেদার গাড়িরবহরে থাকা নেতা-কর্মীদের ওপর কাকরাইলে টিয়ার সেল নিক্ষেপ
খালেদা জিয়ার গাড়িবহর বেলা ১টার দিকে কাকরাইলে প্রধান বিচারপতির বাস ভবনের কাছে পৌঁছালে তার গাড়ির বহরে থাকা নেতা-কর্মীদের ওপর পুলিশ টিয়ার সেল ছোঁড়ে বলে দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।

এসময় কয়েকটি মোটর সাইকেলে আগুন দেয়া হয়। পরে ভিড় অতিক্রম করে খালেদার জিয়ার গাড়ি ধীরে ধীরে আদালতে পৌছায়।

আদালতের ভেতর খালেদা জিয়ার বসার জন্য একটি চেয়ার ও সামনে দুটি ছোট টেবিল রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের কয়েকজন আইনজীবীরা হাজির হয়েছেন।

কারাগারে থাকা মামলার আসামি ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও বিএনপির সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামালকে আদালতে হাজির করা হয়েছে।

মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আদালতের আশপাশ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে।

গত ১৯ ডিসেম্বর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়। এ দিন রাষ্ট্রপক্ষ খালেদা জিয়াসহ সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন। এরপর ২০, ২১, ২৬, ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর এবং ৩ , ৪, ১০ ও ১১ জানুয়ারি খালেদার পক্ষে যুক্ত উপস্থাপন করেন তার আইনজীবীরা। এরপর ১৬ জানুয়ারি শেষ হয় তার পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন।

প্রায় ১০ বছর আগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্বে থাকার সময় এই মামলাটি করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। মামলায় খালেদা জিয়াসহ মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।

সেখানে অভিযোগ করা হয়, এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে পাওয়া ২ কোটি ১০ লাখ টাকা ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দেয়া হলেও, তা এতিম বা ট্রাস্টের কাজে ব্যয় করা হয়নি। বরং সেই টাকা নিজেদের হিসাবে জমা রাখার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

আসামি কারা
দুর্নীতি দমন কমিশনের তখনকার উপ সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ (বর্তমানে উপ-পরিচালক) এ মামলার এজাহারে খালেদা জিয়াসহ মোট সাতজনকে আসামি করেন।

বাকি ছয়জন হলেন- খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমান, জিয়াউর রহমানের বোনের ছেলে মমিনুর রহমান, মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক (ইকোনো কামাল), সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ও সৈয়দ আহমেদ ওরফে সায়ীদ আহমেদ।

দুদক কর্মকর্তা হারুন-অর রশিদ ২০০৯ সালের ৫ অগাস্ট আদালতে যে অভিযোগপত্র দেন, সেখান থেকে গিয়াস উদ্দিন ও সায়ীদ আহমেদের নাম বাদ দেওয়া হয়।

তাদের অব্যাহতির কারণ হিসেবে বলা হয়, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ অনেক আগে থেকে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। অভিযোগে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমান পাওয়া যায়নি। আর সায়ীদ আহমেদ নামে কারও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সাবেক সাংসদ কামাল জালিয়াতি করে ট্রাস্টের কাজে ওই দুই জনের নাম ব্যবহার করেছেন।

কী অভিযোগ
এজাহারে বলা হয়, খালেদা জিয়া তার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম মেয়াদে ১৯৯১-১৯৯৬ সময়কালে এতিম তহবিল নামে সোনালী ব্যাংকের রমনা শাখায় একটি হিসাব খোলেন। একটি বিদেশি সংস্থা ১৯৯১ সালের ৯ জুন ওই হিসাবে ইউনাইটেড সৌদি কর্মাশিয়াল ব্যাংকের মাধ্যমে অনুদান হিসেবে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাার ২১৬ টাকা দেয়।

ওই টাকা দীর্ঘ দুই বছর কোনো এতিমখানায় না দিয়ে জমা রাখা হয়। এরপর জিয়া পরিবারের তিন সদস্য তারেক রহমান, তার ভাই আরাফাত রহমান এবং তাদের ফুপাতো ভাই মমিনুরকে দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করে ওই টাকা তাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, ওই ট্রাস্ট গঠনের ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা মানা হয়নি। এছাড়া ট্রাস্টের ঠিকানা হিসেবে খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের ৬ নম্বর মইনুল রোডের বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে।

পরে ওই টাকা দুইভাগে ভাগ করে ট্রাস্টের বগুড়া ও বাগেরহাট শাখার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫’শ টাকা ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে বরাদ্দ দেওয়া হয় বগুড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে। ওই অর্থ থেকে ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকায় ট্রাস্টের নামে বগুড়ার দাঁড়াইল মৌজায় ২.৭৯ একর জমি কেনা হয়।

কিন্তু অবশিষ্ট টাকা এতিমখানায় ব্যয় না করে ব্যাংকে জমা রাখা হয়। ২০০৬ সনের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত তা সুদে-আসলে বেড়ে ৩ কোটি, ৩৭ লাখ ৭ শ’ ৫৭ টাকা ৩২ পয়সা হয়।

এজাহারে বলা হয়, ২০০৬ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা তার ছেলে তারেক রহমান ও মমিনুর রহমানকে দিয়ে তিন কিস্তিতে ছয়টি চেকের মাধ্যমে তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা তুলে প্রাইম ব্যাংকের গুলশান শাখায় স্থায়ী আমানত (এফডিআর) করেন। এরপর ওই টাকা কাজী সালিমুল হক কামাল ও অন্যদের মাধ্যমে সরিয়ে অন্য খাতে ব্যবহার করা হয়।

মামলায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে ‘নামসর্বস্ব ও অস্তিত্বহীন’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। অপরাধের সময়কাল বলা হয় ১৯৯৩ সালের ১৩ নভেম্বর থেকে ২০০৭ সালের ২৮ মার্চের মধ্যে।

কে কেন আসামি
খালেদা জিয়া: অভিযোগপত্রে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অসৎ উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের নামে পাওয়া টাকা দেশের প্রতিষ্ঠিত কোনো এতিমখানায় না দিয়ে, কোনো নীতিমালা তৈরি না করে, জবাবদিহিতার ব্যবস্থা না করে নিজের পরিবারের সদস্যদের দিয়ে অস্তিত্বহীন ট্রাস্ট সৃষ্টি করে প্রধানমন্ত্রীর পরিচালিত তহবিলের টাকা ওই ট্রাস্টে দেন। পরে বিভিন্ন উপায়ে ওই টাকা আত্মসাত করা যায়, যার জন্য খালেদা জিয়াই দায়ী।

তারেক রহমান: প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহায়তায় তার ছেলে তারেক তাদের বাসস্থানের ঠিকনা ব্যবহার করে ‘অস্তিত্বহীন’ জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট সৃষ্টি করেন। ওই ট্রাস্টের নামে সোনালী ব্যাংকের গুলশান নর্থ সার্কেল শাখায় হিসাব খুলে সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের টাকা জমা করেন। পরে ট্রাস্ট ডিডের শর্ত ভেঙে ওই টাকা তিনি ট্রাস্টের সঙ্গে সম্পর্কহীন সালিমুল হক কামালকে দেন। পরে সেখান থেকে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আত্মসাত করা হয়।

মমিনুর রহমান: তারেকের ফুপাতো ভাই মমিনুর রহমানও একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের টাকা আত্মসাতে সহযোগিতা করে অপরাধ করেছেন।

কাজী সালিমুল হক কামাল: সাবেক সাংসদ সালিমুল হক কামালের সঙ্গে ওই ট্রাস্টের কোনো সম্পর্ক না থাকার পরও তিনি তারেক রহমানের কাছ থেকে পাঁচটি চেক নিয়ে এফডিআর করেন এবং পরে তা ভাঙান। সে সময় প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি শাখা ব্যবস্থাপকদের দিয়ে সৈয়দ আহমেদ ও গিয়াস উদ্দিন আহমেদ নামের দুই ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে এফডিআর ভাঙিয়ে সেই টাকা শরফুদ্দিন আহমেদের অ্যাকাউন্টে জমার ব্যবস্থা করেন।

কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী: তখনকার মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল গঠন ও পরিচালনার জন্য কোনো নীতিমালা তৈরি না করে, কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থা না করে তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অনুমোদন নিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের দিয়ে অস্তিত্বহীন ট্রাস্ট সৃষ্টি করে সেখানে এতিম তহবিলের টাকা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের মূল নথি সংরক্ষণ না করে তা তিনি গায়েব করে দেন। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তিনি ওই অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় খালেদা জিয়া ও তার পরিবারকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন।

শরফুদ্দিন আহমেদ: ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন এই আত্মসাতে সহযোগিতা করে ব্যংকে তার নিজের নামের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে আত্মসাতের প্রক্রিয়ায় অংশ নেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *