উপাচার্যের কার্যালয়ে ছাত্রলীগ মারল আন্দোলনকারীকে

Radio বিচিত্র

d0c7a233095c039dcc30ebb180c3b401-5a5d100aae53f

 

 

 

 

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে চলমান ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারী মশিউর রহমানকে উপাচার্যের কার্যালয়ের ভেতরে নিয়ে মারধর করেছেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী। এরপর তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

 অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রীদের সঙ্গেও অশোভন আচরণ করেছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ছাত্রলীগের এই ভূমিকার সুফল পায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নেতা-কর্মীদের হুমকি-ধমকি, মহড়া, ইভ টিজিং আর গালিগালাজের ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নস্যাৎ হয়ে যায়।

আন্দোলনের সমন্বয়কারী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মশিউর রহমান রাত সাড়ে ৯টায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ছাড়া পাননি। উপাচার্যের কার্যালয় থেকে কলাভবনের প্রক্টরের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় কেঁদে ফেলেন। মশিউর রহমান বলেন, ‘আজকে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হিসেবে লজ্জিত বোধ করছি।’

প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, মশিউরকে এই আন্দোলনের মূল ইন্ধনদাতা বলে মনে করা হচ্ছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

গতকাল সোমবার ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’–এর ব্যানারে ক্লাস বর্জন কর্মসূচি শেষে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনকালে এসব ঘটনা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সরকারি সাতটি কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচির আয়োজন করেন।

গতকালের ঘটনা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ছাত্রলীগ ব্যবস্থা নিয়েছে—এ কথা বলা যাবে না। এখানে প্রক্টর ছিলেন, প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা ছিলেন। ওরা (ছাত্রলীগ) এসেছিল, ওরা পরিস্থিতি জানতে আসে, রাস্তা আটকে আন্দোলন করছে কেন, জানতে চায়।’ তিনি বলেন, অনেক লোক জড়ো হলে মাঝেমধ্যে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তবে এটা কাম্য নয়।

উপাচার্য বলেন, ‘আমরা আগের দিনই আন্দোলনকারীদের বলে দিয়েছি, সাত কলেজের কোনো কাজ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হবে না। এরপরও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক না। এভাবে সময় নষ্ট করার দরকার ছিল না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে অধিভুক্ত হওয়া রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আগের দিন রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। পরে রোববার ক্লাস বর্জনের কর্মসূচি দিয়ে সেদিনের মতো কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়। পরে রাতেই ছাত্রলীগের হল শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকেরা হলগুলোতে নির্দেশনা জারি করেন, এই আন্দোলনে যেন কেউ অংশ না নেন। যাঁরা আন্দোলনের সমন্বয় করছিলেন, তাঁদের ডেকে নিয়ে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন ফেসবুকে লেখেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক অবরোধ, ক্লাস–পরীক্ষা বন্ধের কথা বলা, শান্তিপূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করা এবং অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা একেবারে অবাঞ্ছনীয় ও অগ্রহণযোগ্য।

সব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গতকাল সকাল থেকে ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভে নেমেছিলেন কয়েক শ শিক্ষার্থী। দুপুরের দিকে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) রাজু ভাস্কর্যের চারপাশের রাস্তা অবরোধ করে তাঁরা নিজেদের দাবি জানান। পরে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে যান।

শতাধিক শিক্ষার্থী প্রশাসনিক ভবনে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিলে প্রথমে সেখানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকেরা ঘটনাস্থলে যান। তাঁরা আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদের নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আন্দোলনকারীরা বলেন, তাঁদের কোনো প্রতিনিধি নেই। উপাচার্য সবার সঙ্গে দেখা করবেন। তখন নেতারা উপাচার্যের কার্যালয়ে প্রবেশ করেন।

এরপর শুরু হয় ছাত্রলীগের ‘অ্যাকশন’। কেউ অবস্থানকারীদের ওপর হামলা করেননি। হলগুলোর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের নেতৃত্বে কয়েক শ নেতা-কর্মী আন্দোলনকারীদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন। পাশে মল চত্বরে চলে দফায় দফায় মহড়া। প্রথমে হলের নেতারা নিজ নিজ হলের শিক্ষার্থীদের সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। শেষ পর্যন্ত সেখানে ৩০-৪০ জন ছাত্রীসহ ৫০-৬০ জন অবস্থান করছিলেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গোল হয়ে তাঁদের ঘিরে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন। ছাত্রীদের উদ্দেশ করে নিজেদের মধ্যে অশ্লীল কথা বলছিলেন কেউ কেউ। কেউবা পেছন থেকে বসে থাকা ছাত্রীদের গায়ে পা লাগাচ্ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত একাধিক গণমাধ্যমের সাংবাদিক এ সময় মুঠোফোনে ছবি তুলছিলেন, ভিডিও করছিলেন। একজনের মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলা হয়, একজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়।

একপর্যায়ে সেখানে অবস্থানরত আন্দোলনের সমন্বয়ক মশিউর রহমানকে ধরে উপাচার্যের কার্যালয়ের ভেতরে নিয়ে যান ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। তাঁরা উপাচার্যের কক্ষে ঢোকানোর আগে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের কক্ষে মশিউরকে চড়-থাপ্পড় মারা হয়। পরে উপাচার্যের কার্যালয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা তাঁকে জেরা করেন। মুঠোফোন কেড়ে নেন। ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরাও আন্দোলনে মশিউরের সম্পৃক্ততা নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন।

এ সময় কক্ষের এক কোনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী বসে ছিলেন। উপাচার্য নিজ কক্ষে ছিলেন না, পাশেই লাউঞ্জে একটি অনুষ্ঠানে ছিলেন।

তখনো বাইরে কয়েকজন ছাত্রী অবস্থান করছিলেন। তবে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে দু-একজন করে উঠে যাচ্ছিলেন। ছাত্রলীগের নেতারা তাঁদের সরে যাওয়ার রাস্তা করে দিয়ে গালাগাল করছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনজন ছাত্রীকে ব্যানার নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। ওই সময় ছাত্রলীগের হল পর্যায়ের কয়েকজন নেত্রী সেখানে গিয়ে তাঁদের চলে যেতে বলেন। পরে তাঁরাও চলে যান।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। যদি কেউ করে থাকেন, কারও কাছে প্রমাণ থাকে, তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা এসেছি উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলার জন্য। আমরা সমাধান চাই। আমরা যারা এসেছি, সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সবাই প্রশাসনিক ভবনে যার যার কাজে এসেছে। আন্দোলনকারীদের ওখানে ছাত্রলীগের কেউ ছিল না।’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপ কমানোর অংশ হিসেবে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ফেসবুকে এর বিরোধিতা শুরু করে। ফেসবুকে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ গ্রুপে একটি ইভেন্ট খোলা হয়। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *