পৌষ শেষ হয়ে এসেছে। আসছে মাঘ মাস। কথায় বলে ‘মাঘের শীতে বাঘ পালায়’। এবার পৌষেই অবস্থা তথৈবচ। আশ্চর্যের বিষয় হলো আমাদের দেশের কোমল-কচি শিশুদের পালানোর উপায় নেই। পৌষ কিংবা মাঘ মাসের তীব্র শীতের দিনগুলোয় রোজ সকালে উপস্থিত হচ্ছে স্কুলে। এটা চলছে বাংলাদেশের তাবৎ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলসমূহে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোও পিছিয়ে নেই আয়োজনটি পরিপূর্ণ করতে। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা সম্ভবত আমাদের শিশুদের সুপার বয় কিংবা সুপার গার্ল বলে মনে করছেন। কিংবা হয়তো মনে করছেন তাদের অলৌকিক কোনো ক্ষমতা রয়েছে শীতের তীব্রতাকে পায়ে দলে রোজ সকালে স্কুলে হাজির হওয়ার। গ্রাম-দেশে এবং দরিদ্র এলাকার স্কুলগুলোতে, যেখানে শীতের তীব্রতা ও বাতাসের কামড় বেশি, সেখানকার শিশুদের কথা চিন্তা করুন তো? অনেক এলাকার স্কুলেই শীতে শীশুদের উপস্থিতি কমে যায়। প্রচণ্ড শীতে কুঁকড়ে যাওয়া শিশুদের দেখেও তাদের বার্ষিক পরিকল্পনাটি নতুনভাবে পুনর্বিন্যাস করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না!
যদিও এ বছরের শীতের তীব্রতা গত কয়েক বছরের শীতকে হার মানিয়েছে, তবে তীব্র শীতে স্কুল খোলা রাখার বিষয়টি কিন্তু বাংলাদেশে নতুন নয়। সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় কিংবা কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোয় মোটামুটিভাবে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যেই বার্ষিক পরীক্ষা ও ফলাফল দেওয়ার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়। অন্যদিকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে এ বছরের জুলাই থেকে পরের বছরের জুনকে শিক্ষাবর্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই স্কুলগুলো মোটামুটিভাবে নভেম্বরের মধ্যেই অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা সমাপ্ত করে। এরপর এক থেকে দেড় মাস শীতকালীন ছুটি কাটিয়ে শিক্ষার্থীরা জানুয়ারির প্রথমার্ধে ফাইনাল টার্মের ক্লাস শুরু করে। অর্থাৎ তুলনামূলক কম শীতের সময়টি শীতকালীন ছুটি হিসেবে কাটিয়ে ভরা শীতের মৌসুমে প্রতিদিন সকালে তারা স্কুলের পথে পা বাড়ায়। হাড় কাঁপানো শীতে সূর্যের আলো ফোটার আগেই তাদের টেনেহিঁচড়ে তোলা হয় ঘুম থেকে। তাদের ঘুমকাতুরে নমনীয় শরীর আর ঢুলুঢুলু চোখ নীরবে জানান দেয়, এই শিক্ষাদানপদ্ধতি তারা ভালোবাসে না, যা বিন্দুমাত্র বিবেচনা করে না তাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা। একই সঙ্গে নিষ্ঠুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তাদের মা-বাবা। অসহায় মা-বাবা জোর করে সন্তানকে ডেকে তোলেন ঘুম থেকে। তাঁরা তাঁদের এই নিষ্ঠুরতাকে দায়িত্ববোধের মোড়কে সাজিয়ে নিজেরা সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করেন; কিন্তু পারেন কি? তাঁদের অন্তরের গভীরে থেকে যায় এই শীতে অন্তত আরও কিছুক্ষণ সন্তানকে উষ্ণ রাখার আকুতি।
একদিকে শীতের কামড় আর অন্যদিকে দানবাকৃতির বইয়ের বোঝা নিয়ে শিশুরা হাজির হয় স্কুলে। এমনিতেই পড়ার চাপে শিশুদের শৈশব এখন অনেকটাই বিবর্ণ। কিন্ডারগার্টেন আর ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোয় এই চাপ যেন আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। স্কুলভেদে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশুদের জন্য আয়োজন করে রেখেছে তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রি স্কুলিং কার্যক্রম। এই শিশুরাও রোজ সকালে তীব্র শীতের মধ্যে হাজির হচ্ছে স্কুলে। কেউবা হাই তুলতে তুলতে, কেউ ঘুমাতে ঘুমাতে আবার কেউবা দুধের ফিডারটি মুখ থেকে সরিয়েই প্রবেশ করছে স্কুলে। এই ভয়াবহ শীতে দুধের শিশুগুলোকে কি অন্তত একটু রেহাই দেওয়া যায় না? আবার অবকাঠামোগত তারতম্য থাকলেও শহর কিংবা গ্রামে অনেক শিশুর বাড়ির অবস্থান স্কুল থেকে বহু দূরে। তাদের বেলায় শীতের প্রকটতার সঙ্গে যুক্ত হয় নিরাপত্তার বিষয়টি। সূর্যের আলো ফোটার আগেই বাড়ির বাইরে শিশুরা কতটা নিরাপদ, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।
আমরা সবাই জানি, জানুয়ারি বছরের শীতলতম মাস। এই বাস্তবতা বিবেচনা করে স্কুলের কর্মপরিকল্পনা পুনর্বিন্যাস করা জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোয় সাধারণত বছরের প্রথম দিনগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি, রুটিন প্রণয়ন, বার্ষিক পাঠপরিকল্পনা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ইত্যাদি বিষয় সম্পন্ন করা হয়। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার বিষয়টি কিন্তু অনায়াসেই ডিসেম্বর মাসে সম্পন্ন করা সম্ভব। চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অনুষ্ঠিত হতে পারে। আর বাকি কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য শিশুদের শ্রেণিতে উপস্থিত হওয়া জরুরি নয়। শুধু শিক্ষকেরা স্কুলে হাজির হয়ে কাজগুলো করতে পারেন। তাই ডিসেম্বর মাসটির পূর্ণ ব্যবহার করে সম্পূর্ণ জানুয়ারি মাসটি শিশুদের জন্য শীতকালীন ছুটি হিসেবে ভাবা যেতে পারে। স্কুলের বার্ষিক কর্মপরিকল্পনাটি এই বিবেচনায় করা হলে তীব্র শীতে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু এলাকার স্কুল বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা হবে না।
অন্যদিকে ইংরেজি মাধ্যম ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো আরও পরে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার আয়োজন করে জানুয়ারি মাসটি স্কুল বন্ধ রাখার বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। অনেকে ভাবতে পারেন, তাহলে বই উৎসবের কী হবে! বই উৎসব অবশ্যই হবে। সেই দিনটিতে স্কুল সাজবে, সাজবে শিশুরা। শিশুরা স্কুলে আসবে, বই নেবে এরপর মহা আনন্দে বই নিয়ে তারা বাড়ি ফিরবে। নতুন বই তারা ছুঁয়ে দেখবে, ঘ্রাণ নেবে, অনুভব করবে, ভালোবাসবে, বইয়ের সঙ্গে মিতালি গড়ে তুলবে। এই তীব্র শীতের একটি মাস তারা নাহয় খানিকটা আরামে আর উষ্ণতায় বাড়িতেই কাটাল। তাতে এমন কোনো বড় ক্ষতি হবে না। হয়তো এতে তেমন কোনো দৃশ্যমান লাভও হবে না। তবে স্কুলে যাওয়ার প্রতি তাদের যে অভক্তি তৈরি হবে না, এটা নিশ্চিত। কারণ যে শিক্ষাব্যবস্থা শিশুদের শৈশবকে বিবেচনায় আনে না, যে শিক্ষাব্যবস্থা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবিক আচরণ করে না; তা কখনোই শিশুদের কাছে আদরণীয় হতে পারে না। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ স্কুল পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান, শীতের সকালে কাঁথা-কম্বল কিংবা লেপের ওমে আরও কিছুদিন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দিন আমাদের শিশুদের।